Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভালো নেই চরের তাঁতিরা


২৩ অক্টোবর ২০১৮ ০৯:৩৩

।। ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট।।

কুড়িগ্রাম: জেলার রৌমারী উপজেলার ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকার প্রত্যন্ত চরাঞ্চল চরকাজাইকাটা গ্রামের নিজ বাড়িতে নিজের তাঁতে গভীর মনোযোগে মহিলাদের শীতের চাদর বুনছেন জামাল উদ্দিন (৫৫)।

বাপ-দাদার হাত ধরে শেখা তাঁত শিল্পের এ কাজটাই তিনি করছেন ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু আজ থেকে ২০ বছর আগে মনের যে উৎফুল্ল চিত্তে মহিলাদের পরনের হরেক রকমের শাড়ি, পুরুষদের পরনের লুঙ্গি, গামছা, গায়ের চাদর, বিছানার চাদরসহ নিত্য ব্যবহার্য কাপড় তৈরি করতেন এখন সে উৎফুল্ল মন আর নেই। এখন জীবন-জীবিকার তাগিদে তৈরি করছেন শুধু মহিলাদের শীতকালীন চাঁদর। তার সঙ্গে কাজ করছেন আরো দুজন শ্রমিকও। আর পাশে বসে চরকায় চাঁদর বুননের সুতা গুটিয়ে দিচ্ছেন তার স্ত্রী রাবেয়া বেগম।

জামাল উদ্দিনের রঙিন সুতোয় চাঁদর বোনা দেখে দেখে তার সামনে হাজির হতেই তিনি হতাশার চোখ তুলে তাকালেন এ প্রতিবেদকের দিকে। কেমন আছেন জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বসতে বলতে বলতে বললেন- ‘ভালো নেই বাবা।’

নিজের তাঁতে কাপড় বুনছেন কিন্তু ভালো নেই কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে জামাল উদ্দিন বলা শুরু করলেন, ‘আগের যুগ আর নেই বাবা। আজ থেকে ১৫ বছর আগেও ২০টি তাঁতে কাপড় বুনেও চাহিদা মেটানো যেত না। আর এখন সব বন্ধ করে দিয়ে মাত্র তিনটি তাঁত চালু রেখেছি। যা কাপড় তৈরি হয় ভালো দামেও বেচতে পারি না। তার ওপর ঋণের কিস্তি। ভালো থাকি কেমন করে?’

জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমান বাজারে সুতার দাম বেশি, জড়ির দাম বেশি, শ্রমিকের হাজিরা বেশি। অথচ বেশি দামে উপকরণ কিনে কিস্তির টাকার চাপে একজোড়া চাদর মাত্র তিনশ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। তাতে উৎপাদন খরচই উঠছে না। তবে কিস্তির ঝামেলা না থাকলে উৎপাদিত এসব চাদর মজুদ করে রেখে শীতকালে বিক্রী করতে পারলে পাঁচশ টাকা জোড়া পাওয়া যায়। তখন একটু লাভ থাকে।

বিজ্ঞাপন

কত টাকা লোন নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা লোন নিয়ে সুতা কিনে চাদর তৈরি করছি। কিন্তু প্রতি সপ্তাহে ১৩শ টাকা কিস্তি দিতে হয়। সরকার যদি আমাদের অল্প সুদে লোনের ব্যবস্থা করে দিতো তাহলে আমরা চাদর মজুদ করে শীতকালে বিক্রি করে লাভ করতে পারতাম।’

জামাল উদ্দিনের মতোই হতাশার কথা শোনালেন একই গ্রামের তাঁত মালিক লেবু (৩৫) ও আব্দুস সালাম (৬০)।

আর পার্শ্ববর্তী চরশৌলমারী গ্রামের বন্ধ করে রাখা তাত মালিক মোসলেম উদ্দিন জানান, আমাদের নিজস্ব কোনো তহবিল নাই। এনজিও থেকে লোন নিয়ে সুতা কিনে আনি। কাপড় তৈরি করে মজুত করতে পারি না। কিস্তির চাপে কম দামে বিক্রি করতে হয়। ফলে লাভের জায়গায় লোকসানের খেসারত দিতে হয়। তাছাড়া বাকিতে কাপড় বিক্রি করে সময়মতো টাকাও পাওয়া যায় না। এ জন্যই বর্তমানে তাঁত বন্ধ করে রেখেছি। তবে সরকার যদি আমাদের ব্যাংক থেকে কম সুদে লোনের ব্যবস্থা করে না দেয় তাহলে আর বাপ-দাদার এ শিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

এলাকাবাসী জানায়, প্রায় এক থেকে দেড়শো বছর আগে চরাঞ্চলের এই এলাকায় বসত গড়ে তাতে কাপড় বুনতে শুরু করে কয়েকটি পরিবার। তখন চরের জমিতে চাষাবাদ করা ফসল দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। সে সময় এই তাতে কাপড় বুনে জীবিকা নির্বাহ করা পরিবারগুলোর দেখা দেখি ঘরে ঘরে তাঁতের প্রসার ঘটতে থাকে। পরবর্তীতে রৌমারী উপজেলার বিভিন্ন চরাঞ্চলে প্রায় ২০ হাজার তাঁত শিল্প গড়ে উঠে। রৌমারীর তাঁতে বোনা নিত্য প্রয়োজনীয় কাপড় হয়ে উঠে রংপুর অঞ্চলের মানুষের প্রধান প্রধান পোশাক। এই কাপড় স্থানীয় পাইকারদের মাধ্যমে দেশের বড় বড় কাপড় মার্কেট টাঙ্গাইল, বাবু বাজার হয়ে চলে যেতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এরপর রঙিন সুতোয় তাঁতের স্বর্ণযুগ চলতে থাকে ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত।

বিজ্ঞাপন

এরপর থেকে জীবন-জীবিকার ব্যায় বৃদ্ধিতে আর্থিক টান, সুতার দাম বৃদ্ধি, উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য না পাওয়া, বৈদেশিক বাজার সৃষ্টি করতে না পারা, দেশের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে না পারা, যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক হওয়া এবং সরকারিভাবে কোনো সহযোগিতা না পাওয়ায় একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এসব তাঁত শিল্প। বর্তমানে এই তাঁতের সংখ্যা কমতে কমতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে পড়েছে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার প্রায় এক থেকে দেড়শ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী তাঁত শিল্প।

সরেজমিনে দেখা যায়, রৌমারী উপজেলার চর শৌলমারী ও বন্দবের ইউনিয়নের চরকাজাইকাটা, ফুলকারচর, খেওয়ারচর, গেন্দার আলগা, সোনাপুর, চরশৌলমারী, বাঘমারা ও পালেরচর গ্রামের বেশির ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেলেও অল্প কিছু তাঁত সচল রয়েছে। যার সংখ্যা দুই হাজারের বেশি হবে না।

এ ব্যপারে চর শৌলমারী ইউপি চেয়ারম্যান কে এম ফজলুল হক মণ্ডল বলেন, আমার ইউনিয়নের চর কাজাইকাটা, ফুলকারচর, খেওয়ারচর, গেন্দার আলগা, সোনাপুর, চরশৌলমারী ও বন্দবেড় ইউনিয়নে বাঘমারা, পালেরচরে প্রায় বিশ হাজার তাঁত ছিল। তা বন্ধ হতে হতে এখন এখন সব গ্রাম মিলে সচল তাঁত আছে দুই হাজারের মত।

তিনি আরও বলেন, তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য উপজেলা সমন্বয় সভায় সল্প সুদে ঋণের জন্য রেজুলেশন করে জেলায় পাঠানো হয়। কিন্তু তার কোনো অগ্রগতি নেই। ফলে আমার ইউনিয়নের তাঁতগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর এ কারণে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। এদের জন্য জরুরিভাবে সরকারি ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বিদেশে রফতানি করার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।

কুড়িগ্রাম নগরীর ডিএম রহিদুল ইসলাম খান জানান, আমি এক বছর ধরে কুড়িগ্রাম বিসিক শিল্প নগরীর দায়িত্বে আছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত রৌমারী উপজেলার কোন তাঁত মালিক আমার কাছে আসেনি। এরমধ্যে গত বছর আমরা শতরঞ্জি প্রকল্পের মাধ্যমে উলিপুরের কিছু নারীকে ট্রেনিং ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছি। তারা পাপোশ, ওয়ালমেটসহ বিভিন্ন শতরঞ্জি সামগ্রী তৈরি করছে। তাছাড়া আমাদের এখান থেকে তাঁত শিল্পে লোন দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এটা রংপুর থেকে করা হয়।

এ বিষয়ে রংপুর বিসিক অফিসের প্রমোশন অফিসার ও শতরঞ্জি প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এহসানুল হক বলেন, ‘আমরা কুড়িগ্রাম বিসিক শিল্প নগরীর পরামর্শে কুড়িগ্রাম ও উলিপুর উপজেলায় ১৯৫ জন পুরুষ-মহিলাকে ট্রেনিং ও আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছি। তারা শতরঞ্জি সামগ্রী তৈরি করছে। কুড়িগ্রাম বিসিক অফিস যদি মনে করে তাহলে রৌমারী উপজেলার তাঁত শিল্পদের ট্রেনিং ও আর্থিক সহায়তা করার সুযোগ আছে।’

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক মোছা. সুলতানা পারভীন বলেন, ‘আমি রৌমারী উপজেলার তাঁত শিল্পের বিষয়ে খোঁজ-খবর নিচ্ছি। সরেজমিনে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলে যে রকম সুবিধা দিলে তারা এই তাঁত শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখে স্বাবলম্বী হতে পারবে আমরা সেরকম সুবিধা দেব।’

সারাবাংলা/একে

কুড়িগ্রাম জীবন-জীবিকা তাঁতিরা বস্ত্রশিল্প

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর