রোহিঙ্গা শিশু জোহার পেল সর্বোচ্চ চিকিৎসা
২৪ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:২৭
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নির্ধারিত ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা গেল পাঁচ বছরের শিশুটি জিন্সের প্যান্ট আর মেরুন রঙের টি-শার্ট পরে ওয়ার্ডের এ মাথা থেকে ও মাথা দৌড়ে বেড়াচ্ছে। শিশুটির বাবা তখন ওয়ার্ডের ভেতরে জিনিসপত্র কিছু রয়ে গেল কি না— তা দেখতে ব্যস্ত। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একজন চিকিৎসকসহ এ প্রতিবেদক ওয়ার্ডে ঢুকতেই থেমে যায় ব্যস্ততা। আর পাঁচ বছরের শিশুটিও হঠাৎ করেই চুপ হয়ে যায়। তবে তখনও তার মুখে এক চিলতে হাসি।
ভুবন ভোলানো হাসি মুখের ছেলেটির নাম নুরুল জোহার। পাঁচ বছর আট মাস বয়সী জোহার মিয়ানমারের নাগরিক। গত বছর সেপ্টেম্বরে জোহারের বাবা মোহাম্মদ কুতুব আলী পুরো পরিবার নিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফের থ্যাংখালিতে আশ্রয় নেন। তারপর থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাটছে তাদের দিন।
গত ২ ফেব্রুয়ারিতে ক্যাম্পে অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলার সময় জোহার শরীরের ওপর দিয়ে টমটম গাড়ির চাকা চলে যায়। এতে করে গুরুতর আহত হয় জোহার, পেট ফুলে যায়। পেটের ভেতরের অনেক রক্তক্ষরণ এবং খাদ্যনালী-লিভারসহ খাদ্য বিপাকক্রিয়ায় সহায়ক অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হয়। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ফিল্ড হাসপাতালে প্রথমে পেটে অস্ত্রোপচার করা হয়, রক্তক্ষরণ আর আঘাতের কারণে তার প্লিহা কেটে বাদ দিতে হয়।
এরপর কক্সবাজারের ডুলাহাজরাতে মেমোরিয়াল খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতালের ২৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় অস্ত্রোপচার হয় জোহারের। এরপর থেকে জোহার তাদের তত্ত্বাবধানে থাকে। মে মাসে তৃতীয় অস্ত্রোপচারে দেখা যায়, তার ক্ষুদ্রান্ত-লিভার ও আশেপাশের অন্যান্য অঙ্গ একসঙ্গে পেঁচিয়ে ছিল, আটকে ছিল। জোহার ছোট একটা বাচ্চা। কিন্তু ওই হাসপাতালের মার্কিন সার্জন ডা. নাথান শিশু চিকিৎসায় বিশেষায়িত ছিলেন না। তখন তারা চিন্তা করেন, তাদের আর বিষয়ে কিছু করা ঠিক হবে না।
জোহারের আরও ভালো চিকিৎসার জন্য হেপাটোবিলিয়ারি সার্জারিতে কারা কাজ করেন, সেই খোঁজ শুরু হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান ও সার্জারি অনুষদের ডিন এবং হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড প্যানক্রিয়েটিক সার্জারি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জুলফিকার রহমান খানের সঙ্গে ডা. নাথান ফোনে যোগাযোগ করেন। তখন তিনি চিন্তা করেন, বাচ্চাটিকে বাইরে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু একটি রোহিঙ্গা শিশুকে কক্সবাজারে বাইরে নিতে হলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার অনুমতির প্রয়োজন। আবার ডা. জুলফিকার রহমান খান স্যারও একজন ‘অ্যাডাল্ট সার্জন’। তার মনে হয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগে হয়তো জোহারের ভালো চিকিৎসা হবে এবং খরচও লাগবে না।
সেই ভাবনা জানানোর পর ডা. জুলফিকার রহমান খান ফোন দেন ডা. নাথানকে; জানান ঢামেক হাসপাতালের নবজাতক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান এবং ন্যাশনাল চিলড্রেন হসপিটাল অ্যান্ড ইনস্টিটিউটের প্রজেক্ট ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. আবদুল হানিফ টাবলুর কথা। তার সঙ্গে যোগাযোগ করেই স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সব দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জোহারকে নিয়ে আসায় ঢামেক হাসপাতালে।
ডা. টাবলু সারাবাংলাকে বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন আমাকে। জোহারের জন্য একটি কেবিন বরাদ্দ করেন হাসপাতালের পরিচালক। পরে বাচ্চাটিকে তার বাবা, দোভাষী সুকর্ণ ঘোষ এবং আমেরিকান নার্স জেসিকা লুইসসহ তারা পাঠিয়ে দেন এখানে। গত ৮ আগস্ট জোহারকে ভর্তি করার পর ডা. জুলফিকার রহমান খানসহ একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। সেখানে আরও ছিলেন পেডিয়াট্রিক সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক কাজল, অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলি, গ্যাস্ট্রোঅন্ট্রোরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. ফারুক আহমেদ, শিশু মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ, অধ্যাপক তপন কুমার সাহা ও ডা. জগলুল গাফফার খানসহ অন্যরা।
তখন জোহারের অবস্থা কেমন ছিল— জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. আবদুল হানিফ টাবলু বলেন, জোহারের অবস্থা ছিল বেশ জটিল। বলা যায়, কোনোরকমে ওকে বাঁচিয়ে রাখা হচ্ছিল। শরীর থেকে পিত্ত বের হয়ে গিয়েছিল, পিত্ত বের হয়ে গেলে মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না। তাই পাকস্থলীতে ছিদ্র করে একটি নল দিয়ে পিত্তকে আবার শিশুটির শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে তিনটি নল নিয়ে বেঁচে ছিল জোহার। আমাদের চ্যালেঞ্জ ছিল, অস্ত্রোপচার করে তার ক্ষতিগ্রস্ত পিত্তনালীকে পুনর্গঠন বা প্রতিস্থাপন করা। একটু কিছু হলেই তার লিভারসহ অন্য অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
সে অবস্থায় প্রয়োজনীয় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত হয়, জোহারের যে নালী ছিঁড়ে গিয়েছিল, সেটা ক্ষুদ্রান্ত দিয়ে পুনর্গঠিত করা হবে। এরপর গত ১৭ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত প্রায় ছয় ঘণ্টাব্যাপী ‘রু অ্যান্ড ওয়াই হেপাটিকো জেজুনোস্টমি’ নামের এই জটিল অস্ত্রোপচার চলে, জোহারের খাদ্যনালীর সঙ্গে পিত্তনালীর সংযোগ প্রতিস্থাপন করা হয়।
অস্ত্রোপচারটি খুবই জটিল ছিল উল্লেখ করে ডা. টাবলু জানান, জুলফিকারের স্যারের নেতৃত্বে অস্ত্রোপচার দলে তিনিসহ ছিলেন অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক কাজল, অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলি, ডা. জগলুল গাফফার খান, ডা. বিপ্লব, ডা. পার্থ, ডা. আদিল, ডা. জিয়া, ডা. মোরশেদসহ অন্যরা। অস্ত্রোপচার সফল হয়। পরে পেটের ভেতরে থাকা অন্য টিউব পর্যায়ক্রমে খোলা হয়। এরপর থেকেই জোহার চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে ছিল। অন্য কোনো সমস্যা না তৈরি হওয়ায় এবং জোহার সম্পূর্ণ সুস্থ থাকায় মঙ্গলবার (২৩ অক্টোবর) তাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেওয়া হয়।
এটা খুব বিরল অস্ত্রোপচার ছিল কি না— জানতে চাইলে ডা. আবদুল হানিফ টাবলু বলেন, এ ধরনের কিছু জন্মগত ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করা শিশুদের অস্ত্রোপচার আমরা করেছি। কিন্তু অ্যাকসিডেন্টের কারণে বাচ্চাদের এ ধরনের অস্ত্রোপচার বিরল।
আরও পড়ুন: দেশে স্বাস্থ্যসেবা পায়নি রোহিঙ্গা শিশুরা, নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত
আরও পড়ুন: রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জন্ম নেওয়া শিশুর হিসাব নেই কারও কাছে!
জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. জুলফিকার রহমান খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘সেপটিসেমিয়া হয়ে যেকোনো সময় মারা যাওয়ার ঝুঁকি ছিল শিশুটির। চতুর্থবার এই অস্ত্রোপচারটি শিশুদের ক্ষেত্রে বিশ্বে বিরল এবং বাংলাদেশে প্রথম। আমি বলব, এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অপারেশন এবং এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত বড় একটি অর্জন। আমি খুবই সন্তুষ্ট।’
অস্ত্রোপচার দলে থাকা নবজাতক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক ডা. মাহবুবুল আলম বিপ্লব বলেন, বিষয়টি কেবল চিকিৎসা সংক্রান্ত নয়। শিশুটি তার নিজ দেশে ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও যে অমানবিক জীবনে ছিল, সেই জীবন থেকে নিয়ে এসেও যে তাকে আমরা আমাদের সাধ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চ চিকিৎসা দিতে পেরেছি, এটি একটি বড় বিষয়।
‘রোহিঙ্গাদের আমরা থাকতে দিয়েছে, খেতে দিয়েছি— এটা সবাই জানে। কিন্তু তাদের যে আমরা সুপার স্পেশালাইজড চিকিৎসা দিচ্ছি, এটা মানুষ জানে না। কিন্তু জানা দরকার। দেশের চিকিৎসকরা তাদের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে এই রোহিঙ্গা শিশুটির চিকিৎসা দিয়েছে। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমি গর্বিত এজন্য,’— বলেন ডা. মাহবুবুল।
সারাবাংলা/জেএ/টিআর
কক্সবাজার নুরুল জোহার রোহিঙ্গা রোহিঙ্গা ক্যাম্প রোহিঙ্গা শিশু স্বাস্থ্যসেবা