Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বেপরোয়া ব্যবসায় ঝুঁকিতে রিসোর্ট শিল্প


২৫ অক্টোবর ২০১৮ ০৯:৩০

মনোমুগ্ধকর অরুনিমা রিসোর্ট

।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর ।।

ঢাকা: কংক্রিটের শহর, যান্ত্রিক জীবন, ভীষণ কোলাহল— এর মধ্যে থেকে প্রতিনিয়তই মন চায় সবুজের মধ্যে কোথাও পালিয়ে যাই। যেখানে খোলা আকাশ আছে, গাছ আছে, পাখি আছে, নদী আছে; সঙ্গে আছে শহরের সুযোগ-সুবিধাগুলোও।

সারা পৃথিবীতেই মানুষ প্রকৃতির কোলে এমন আয়েশ খোঁজে। সেই খোঁজ থেকে দুনিয়াজুড়ে গড়ে উঠেছে রিসোর্টের ধারণা। বিশাল এলাকাজুড়ে থাকার জায়গা, সুইমিং পুল, বাচ্চাদের খেলার জায়গা, বিস্তীর্ণ আকাশ— সব মিলিয়ে প্রকৃতির কোলে আরামের জায়গা হিসেবে রিসোর্ট একটি খুব জনপ্রিয় ধারণা। অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশেও জনপ্রিয় রিসোর্টের ধারণাটি। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যম আয়ের দেশের রিসোর্ট পর্যটকের সংখ্যাও এখন কম নয়। সেই চাহিদার কথা মাথায় রেখে দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে শতাধিক রিসোর্ট। তবে রিসোর্টের সঙ্গে গড়ে ওঠেনি সেগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, অভিযোগ নিষ্পত্তির সুযোগ। এমনকি নেই মান নিরীক্ষণের কোনো কর্তৃপক্ষও।

খুব সম্প্রতি গাজীপুরের সাহারা রিসোর্ট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট আসে। এতে অভিযোগকারী জানান, সাহারা রিসোর্টের জ্যাকুজি (হট টাব) কারিগরি ত্রুটির ফলে গা পুড়ে যায় সেই অভিযোগকারীর। তৎক্ষণিকভাবে রিসোর্ট কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হলে তারা গ্রহকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে।

অভিযোগ শুধু সাহারা রিসোর্টের বিরুদ্ধে নয়। এমন অভিযোগ ভুরি ভুরি পাওয়া যায় ফেসবুক খুললে। নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পারমিতা ইসলাম সম্প্রতি ঘুরে এসেছেন সিলেটের শুকতারা রিসোর্ট। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের একদিন থাকার কথা থাকলেও আমরা সেখানে গিয়ে আরও একদিন বেশি থাকার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ আমাদের অনুমতি না নিয়েই সুইমিং পুল পরিষ্কার শুরু করে। আমাদের জানানো হয়, পুল ভরতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগবে। পরে এটা নিয়ে প্রতিবাদ করায় বিল নেওয়ার সময় কিছুটা ছাড় দেয় শুকতারা কর্তৃপক্ষ, জানান পারমিতা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের রিসোর্টগুলোর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ খুব নিয়মিত, দুয়েকটা রিসোর্ট ছাড়া প্রায় প্রতিটির বিরুদ্ধেই। কোথাও হয়তো খাবারের মান খারাপ, কিন্তু উচ্চমূল্য; কোথাও মূল রাস্তা থেকে রিসোর্ট পর্যন্ত যাওয়ার পথ খুব খারাপ; কোথাও রিসোর্টের সব খরচ দেওয়ার পরে আলাদা করে পুলে নামার খরচ চাওয়া হয়। এগুলোর সঙ্গে খুব সাধারণ অভিযোগ হলো— রিসোর্টগুলোতে প্রতিদিনের খরচ হিসেবে ৫ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ রাখা হয়। কিন্তু সে তুলনায় যা সেবা পাওয়া যায়, তা খুব নগণ্য।

খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান ড. সাকের আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, নক্ষত্রবাড়ি রিসোর্টে গিয়ে আমি দেখেছি, খড়ের চালায় ছোট ছোট পোকা; কিন্তু এগুলোর কোনো প্রতিকার নেই।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক মায়েশা তাসনীম বলেন, খুব অল্প সময়ের জন্য যখন দেশের রিসোর্টগুলোতে যাই, তখন প্রায় প্রত্যেকেরই ভাবটা এমন— যেন তারা আমাদের প্রতি কোনো দয়া-দাক্ষিণ্য করছেন। বাংলাদেশের রিসোর্টগুলোর একরাতের দাম কখনও কখনও সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের রিসোর্টগুলোর চেয়েও বেশি। এই দামের বিনিময় আমরা যখন নিম্নমানের সেবা বা খারাপ ব্যবহার পাই, তখন সত্যিই ইচ্ছে করে দেশের বাইরে চলে যাই।

এসব সমস্যার কারণে বাংলাদেশের ট্যুরিজম শিল্পের উদীয়মান এই খাতটি বিকশিত হয়েও হচ্ছে না, বরং হাঁটছে অস্তাচলের পথে। ট্যুরিজম শিল্পে কাজ করেন— এমন একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সারাবাংলাকে জানান, বাংলাদেশের ট্যুরিজম খাতে অনিয়মের কোনো সীমা নেই। এই খাতে ব্যবসায়ীরা যখন শুরু করেন, তখন বিষয়টা খুব ভালো থাকে। এরপর শুরু হয় সমস্যা। দুয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ রিসোর্টে কর্মচারী নিয়োগের সময় কোনো যোগ্যতার তোয়াক্কা করা হয় না। দেওয়া হয় না যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ। এমনকি অনেকে সময়মতো কর্মচারীদের বেতনও দেন না। উপরন্তু সার্ভিস চার্জ হিসেবে যে অর্থটা গ্রাহকদের ওপর আরোপ করা হয়, তা কর্মচারীদের মধ্যে সমানভাগে ভাগ করে দেওয়ার কথা থাকলেও সেই অর্থ ভাগাভাগিতেও স্বচ্ছতা থাকে না।

বিজ্ঞাপন

এসব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নিয়ে ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট খবির উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। তিনি জানান, বাংলাদেশে প্রায় দুই শতাধিক রিসোর্ট আছে। এর মধ্যে মাত্র ১৮ জনকে নিয়ে তাদের এই সংগঠন। খবির উদ্দিন আহমেদ স্বীকার করেন, অনেক রিসোর্ট মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আন্তরিক নয়। তিনি এও জানান, রিসোর্টের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো আইন বা কর্তৃপক্ষ নেই বাংলাদেশে। একটি আইন তৈরির প্রচেষ্টা চলছে, যা খুব শিগগিরই হয়ে যাবে বলে আশা করেন তিনি। তবে খবির উদ্দিন জানান, কোনো গ্রাহক যদি চান তবে স্থানীয় থানায় বা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষকে জানাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে আইনের অভাবের বিষয়টি নিশ্চিত করে ট্যুরিজম বোর্ড কর্তৃপক্ষও।

এই আইন প্রণয়নের অভাবে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পর্যটন খাত— সে ব্যাখ্যা করেন  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. সাকের আহমেদ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ট্যুরিজমের জন্য একটা বড় বাজার আছে। একদম বিদেশ থেকে যদি কেউ নাও আসে, তাও দেশের ভেতরের মানুষ বিভিন্ন জায়গায় বেড়তে যেতে চায়। ফলে এই ধরনের রিসোর্ট ট্যুরিজম খুবই জনপ্রিয়। সারাবিশ্বে রিসোর্ট ট্যুরিজমে পে-ব্যাক পিরিয়ড (যে সময়ের মধ্যে প্রথমিক বিনিয়োগ উঠে আসে) লম্বা হয়। তবে এটা একবার উঠে আসলে এই ধরনের প্রোজেক্ট মুনাফার মুখ দেখে। দুঃখজনকভাবে সত্যি, আমাদের দেশে রিসোর্ট ব্যবসায়ীরা এই দ্রুত মুনাফা করতে ইচ্ছেমতো ব্যবসা করছে। আইন না থাকায় তাদের এ ধরনের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতেও পারছে না কেউ।

আরও পড়ুন: অপার মুগ্ধতার অরুনিমা

ড. সাকের আহমেদের আশঙ্কা, আইনের আওতায় না আনা গেলে অচিরেই ধ্বংসের মুখে পড়বে সম্ভাবনাময় এ শিল্প। তিনি বলেন, যে দামে বাংলাদেশের রিসোর্টগুলোতে থাকতে হয়, সেই সমান দাম দিয়ে নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে এর থেকে ভালো সেবা পাওয়া যায়। পর্যটকরা ধীরে ধীরে সেইসব দেশের দিকে চলে যাচ্ছে। এ কারনে ঈদ-পূজার মতো লম্বা ছুটিতে বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশ ছেড়ে বাইরে গিয়ে সময় কাটায়। শুধু নিয়মনীতির অভাবেই আমরা এ খাতের বিশাল সম্ভাবনাকে হাত ছাড়া করতে যাচ্ছি বলে মনে করেন ড. সাকের।

সারাবাংলা/এমএ/এমএস

ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ রিসোর্ট শিল্প সাহারা রিসোর্ট

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর