পাত্তা পায়নি নির্বাচন নিয়ে মাহবুব তালুকদারের যেসব প্রশ্ন
২৬ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:৫০
।। গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: জাতীয় পার্টি (জাপা) একইসঙ্গে সরকারি ও বিরোধী দলে থেকে সংসদে দায়িত্ব পালন করতে পারে কি না— তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন আলোচিত নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার। একইসঙ্গে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি কতটুকু সম্ভব— তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। ইসির এই কমিশনার বিএনপির নাম উল্লেখ না করে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দায়ের করা নিয়েও কমিশনে আলোচনার দাবি জানিয়েছিলেন।
‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে কতিপয় প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক আন-অফিসিয়াল নোটে (ইউও-নোট) এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন মাহবুব তালুকদার। ১৮ সেপ্টেম্বর জমা দেওয়া এই নোটের একটি সংশোধনীও পাঠিয়েছিলেন তিনি। গত ৮ অক্টোবর এ সংক্রান্ত তিন পৃষ্ঠার ইউও-নোট নির্বাচন কমিশন সভায় উপস্থাপনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ চার কমিশনারের কাছে পাঠানো হয়। তবে তিন নির্বাচন কমিশনারের বিরোধিতার মুখে মাহবুব তালুকদারের ওই ইউও-নোট ইসি সভায় উপস্থাপন করা হয়নি।
ইসি কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম সারাবাংলাকে এই ইউনোটের তথ্য নিশ্চিত করেছেন। গত সোমবার (২২ অক্টোবর) তিনি বলেন, মাহবুব তালুকদারের এই ধরনের প্রস্তাব অপ্রসাঙ্গিক হওয়ায় কমিশন তা আমলে নেয়নি। তার প্রস্তাবগুলো বাস্তবসম্মত না হওয়ায় ইসির আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো সুযোগ ছিল না।
অন্যদিকে ইসির কমিশনার কবিতা খানম ওই সময় সারাবাংলাকে বলেন, মাহবুব তালুকদারের প্রস্তাবনাগুলো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় তা কমিশন সভায় আলোচনা করার বিষয়ে আমরা আপত্তি তুলেছিলাম।
মাহবুব তালুকদারের ওই ইউও-নোটের একটি কপি সারাবাংলার হাতে এসে পৌঁছেছে। তিন পৃষ্ঠার ওই ইউও-নোটে জাতীয় পার্টির নাম উল্লেখ না করে বলেন, ‘একটি দল নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েও পরে নির্বাচন করে এবং পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের একাধারে বিরোধী দল ঘোষণা করে এবং সরকারে অংশগ্রহণের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভায় আসন লাভ করে। একইসঙ্গে সরকারি ও বিরোধী দলে থেকে সংসদে দায়িত্বপালন করা যায় কি না, প্রশ্ন থেকে যায়।’
ওই ইউও-নোটে আরও বলা হয়, ২০১৪ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ায় ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে দেখা যায়। মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে। এতে সার্বিকভাবে নির্বাচনের অনিয়ম বন্ধ হওয়ার পথ উন্মুক্ত হতে পারে। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলে তা গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশকে সমর্থন করে না।’
নির্বাচনের সময় সংসদ বহাল রেখে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতখানি সম্ভব— তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে ইসির করণীয় বিষয়ে জানতে চান মাহবুব তালুকদার। তিনি ইউও-নোটে লিখেছেন, ‘নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বলে একটা কথা আছে। কথাটা আমার কাছে বিভ্রান্তিমূলক বলে মনে হয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের সুনির্দিষ্ট কোনো মাপকাঠি নেই। এটি একটি ধারণামাত্র। যদি সংসদ বহাল থাকে, সংসদ সদস্যদের নিষ্ক্রিয় রাখার ঘোষণা দিলেও কি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি সম্ভব?’
ইউনোটে বিরোধী দলের কর্মসূচিতে বাধাদান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত হলো অংশগ্রহণকারী সব পক্ষের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল যে সুবিধা ভোগ করছে, বিরোধী দল সংবিধান প্রদত্ত অধিকার তুলনামূলকভাবে তেমন ভোগ করতে পারছে না। শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতেও তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিরোধী দলের কমিটি ধরে ধরে মামলা দায়ের কিংবা গায়েবি মামলা দায়ের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। তফসিল ঘোষণার আগে নির্বাচন কমিশনের কার্যকরভাবে কিছু করার সুযোগ না থাকলেও সব পক্ষের প্রতি সমআচরণের স্বার্থে নির্বাচন কমিশন বিবৃতির মাধ্যমে বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিগোচর করতে পারে।’
মাহবুব তালুকদার নির্বাচনকালীন জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ইসির অধীনে ন্যস্ত করার বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ‘সংলাপে সুপারিশে অংশীজনের অনেকে নির্বাচনের সময় সার্বিকভাবে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সরাসরি নির্বাচন কমিশনের অধীনে ন্যস্ত করতে বলেছেন। কেউ কেউ অর্থ, তথ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কেও নির্বাচন কমিশনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছেন। বিষয়টি বিতর্কের, সন্দেহ নেই। তবে আমার কাছে মনে হয়, বিষয়টি বিবেচনাযোগ্য। নির্বাচন কমিশনের কাছে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব অর্পিত হলে জাতীয় নির্বাচনে জনগণের আস্থা বেড়ে যাবে এবং নির্বাচন সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করতে সহায়ক হবে।’
উল্লেখ্য, একাদশ জাতীয় নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের বিরোধিতা জানিয়ে গত ৩০ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের সভা বর্জন করেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ওই সময় তিনি ‘নোট অব ডিসেন্টে’ আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরেন। তবে তার বিরোধিতা সত্ত্বেও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ সংশোধন করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে ভোটগ্রহণের বিধি অনুমোদন করে ইসি।
পরে ১৫ অক্টোবরও ইসির একটি সভা বর্জন করেন মাহবুব তালুকদার। তিনি জানান, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ অংশীদারমূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর একটি ইউও-নোটের মাধ্যমে ইসিতে আলোচনার জন্য কিছু প্রস্তাব দেন। এই নোটটি ইসির ১৫ অক্টোবরের সভায় উত্থাপন করার কথা জানানো হয় তাকে। তবে তিন নির্বাচন কমিশনারের বিরোধিতার মুখে ওই সভায় মাহবুব তালুকদারের ইউও-নোটের প্রস্তাবনাগুলো আলোচনা করা হয়নি। এর প্রতিবাদ হিসেবেই তিনি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে সভা বর্জন করেন।
এদিকে, মাহবুব তালুকদারের প্রস্তাবগুলো ‘অযৌক্তিক ও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ বলেই সেগুলো ইসি সভায় আলোচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেন আরেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
ইসি নির্বাচন নির্বাচন কমিশন মাহবুব তালুকদার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড