আগুন লাগিয়ে পুলিশকে ‘মারতে চেয়েছিল’ বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা
২৬ অক্টোবর ২০১৮ ১৮:৩৬
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: পোস্তগোলায় শুক্রবার সকালে পুলিশ-শ্রমিকদের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা একটি হোটেলে আশ্রয় নেওয়া পুলিশ সদস্যদের আগুন ধরিয়ে ‘মারতে চেয়েছিল।’ তবে পুলিশ আত্মরক্ষায় টিয়ারশেল ও শর্টগানের গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
পুলিশ ও হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের তাণ্ডবে বড় ধরনের অঘটন ঘটে যেতে পারত।
শুক্রবারের সংঘর্ষ চলাকালে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের ধাওয়া খেয়ে সংখ্যায় নগন্য পুলিশ সদস্যরা প্রাণ বাঁচাতে মায়ের দোয়া হোটেলে আশ্রয় নেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ওই পুলিশ সদস্যদের পিছু নিয়ে সেখানে বৃষ্টির মতো ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন। শ্রমিকরা হোটেলের ভেতর ভাঙচুর চালিয়েছেন, এমনকি কাগজপত্র জড়ো করে আগুন ধরিয়ে দেন।
একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের ভেতরে রেখেই গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে এসে ওই আগুনে সংযোগ করেন। নিরূপায় হয়ে হোটেলের ভেতরে থাকা পুলিশ সদস্যরা টিয়ার শেল ও শর্টগানের গুলি ছোড়েন।
শুক্রবার (২৬ অক্টোবর) পোস্তগোলা ব্রীজের দক্ষিণ পশ্চিম অংশে শ্রমিক পুলিশের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সারাবাংলাকে এ সব তথ্য জানান।
ঘটনার ভয়াবহতা উল্লেখ করে ওসি বলেন, ‘পুলিশের কাছে অস্ত্র থাকে আত্মরক্ষার জন্যই তো। আমরা টিয়ারশেল ও শর্টগানের গুলি না করলে আগুনে পুড়ে মরতে হতো।’
তিনি জানান, সেখানে কয়েকজন মহিলা পুলিশ সদস্যসহ, ওসি, পুলিশ পরিদর্শক তদন্তসহ ১০/১২ জন পুলিশ সদস্য ছিলেন। যে গ্যাস সিলিন্ডার আগুনে ফেলে ছিলেন সবাই পুড়ে ছাই হতো। আমাদের বাঁচাতে গিয়ে হোটেল মালিক আহত হয়েছেন। ইট-পাটকেল তার ওপর পড়ে আহত হয়েছেন। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুন নিভিয়েছেন।
শ্রমিকদের ধাওয়ায় হোটেলে আটকেপড়া পুলিশ সদস্য আনিসুর রহমান ইট-পাটকেলের আঘাতে আহত হয়ে কেরানীগঞ্জ ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাজার হাজার শ্রমিক মাত্র ১০/১২ জন পুলিশের ওপর হামলে পড়ে। কী যে নির্মমতা আর কী যে ভয়বহতা তা কোনোদিনও ভুলতে পারব না। হোটেল মালিক দোকানের শাটার নামিয়ে না দিলে সবার যে কী হতো তা আল্লাহ ভালো জানেন। হোটেলে ঢুকে শ্রমিকরা ভাঙচুর করেছে। সেখানে লুকিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের মারধর করেছে। মারধরে আহত পুলিশ সদস্যরা ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে।’
মায়ের দোয়া হোটেলের মালিক সাইদুল ইসলাম সাজু বলেন, ‘আনুমানিক সকাল ৯টা। হোটেলে ক্রেতাদের ভিড় ছিল। হঠাৎ করে ১০/১২ জন পুলিশ সদস্য দৌড়ে আমার হোটেলে ঢুকে পড়েন। দেখি হাজার হাজার শ্রমিক, লাঠি ও ইট-পাটকেল নিয়ে তেড়ে আসেন। আমি ভয়ে একটা শাটার নামিয়ে দেই আরেকটা নামাতে যাই। তবে পারিনি, এর মধ্যেই বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা চলে আসে। তারা এসেই অনেকে দোকানে ঢুকে পড়ে ভাঙচুর করতে থাকে। ভাঙা টেবিলের অংশ দিয়ে পুলিশকে পেটাতে থাকে। আরেক দল বাইরে পরাটা বিক্রির কাগজপত্র জড়ো করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। পাশেই ফ্লেক্সি লোডের দোকান ছিল সেখানেও ভাঙচুর চালায়। নগদ ১০ হাজার টাকা ক্যাশ নিয়ে যায়।’
সাইদুল ইসলাম সাজু বলেন, ‘কয়জনকে সামলামু। এদিকে শ্রমিকরা ইট মারছে আগুন দিচ্ছে অন্যদিকে পুলিশ রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল মারছে। এরপরেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুন নিভিয়েছি। গুলি খেয়েছি, মার খেয়েছি। পাটকেল খেয়েছি। টাকাও চলে গেল। দোকানের সবকিছু ভাঙচুর করেছে।’
দোকানে পুলিশ সদস্যদের আটকিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে শুনে বাঁচাতে দৌড়ে আসেন সাজুর ছোটভাই রাসেল ও এই এলাকার ছিদ্দিকুর রহমান। তাদেরকেও ছররা গুলি খেতে হয়েছে। তাদের মতো পুলিশকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাতে গ্রামের কয়েকজন নারী দৌড়ে আসেন। মার খেতে হয়েছে তাদেরও। তবে পুলিশ তাদের শ্রমিক ভেবেই গুলি চালিয়েছে বলে জানান আহত ছিদ্দিকুর রহমান।
ঘটনার শুরু যেভাবে
পরিবহন শ্রমিকদের দাবি, ২২ অক্টোবর পোস্তগোলা ব্রীজ (বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু) দিয়ে যানবাহন চলাচলের ওপর টোল বাড়ায় ইজারাদার মোহাম্মদ আলম। বর্ধিত টোলের টাকা বাতিলের দাবিতে শুক্রবার সকাল ৭টায় ব্রিজের দক্ষিণ পশ্চিম অংশে রাস্তা ট্রাক দিয়ে ব্যারিকেডের সৃষ্টি করে পরিবহন শ্রমিকরা। সেখান থেকেই মূলত সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার (ওসি) শাহ জামান বলেন, সকাল ৭টার দিকে ট্রাক দিয়ে রাস্তা অবরোধ করে ইজারা আদায়কারীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। পুলিশ থামাতে গেলে শ্রমিকরা পুলিশের ওপর চড়াও হয়। পুলিশ নিরূপায় হয়ে প্রথমে বিআরটিএ তে অবস্থান নেয়। সেখানে একটি ইট বোঝাই ট্রাক দ্রুত চালিয়ে হামলা চালায় শ্রমিকরা। সেখান থেকে হোটেলে আশ্রয় নিলে সেখানেও চড়াও হয় তারা। পরবর্তীতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে অতিরিক্ত পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ছিল। নিয়ন্ত্রণে আনতেই টিয়ারশেল, রাবার বুলেট ও শর্টগানের গুলি ছোড়া হয়েছে। কেউ নিহত বা আহত হয়েছে কিনা তা শুনিনি (দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে)।’ তবে পুলিশের শতাধিক সদস্য আহত হয়েছে বলে জানান তিনি।
ট্রাক চালক আজিজার রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘ট্রাকের জন্য টোল ছিল আগে মাত্র ৩০ টাকা। সেটা গত ২২ অক্টোবর বাড়িয়ে করেছে ২৪০ টাকা। এটা কি মেনে নেওয়া যায়? তা নিয়ে ইজারা না দিয়ে আন্দোলন শুরু করি আমরা। কিন্তু ইজারা আদায়কারীরা অন্যায়ভাবে অস্ত্রশস্ত্র এসে শ্রমিকদের গুলি করে চলে যায়। এরপর পুলিশও দেখি শ্রমিকদের ওপরই চড়াও হয়। তাই বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছে।’
পরিবহন শ্রমিক ফারুক অভিযোগ করে বলেন, ‘পুলিশ কোনো কথা ছাড়াই শ্রমিকদের ওপর হামলা চালালে শ্রমিকরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। কয়েকজনকে গুলি করে মেরেছে। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছে। একজন বিক্ষুককেও গুলি করেছে পুলিশ।’
তবে ট্রাক শ্রমিকের এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইজারাদার ও আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ আলম। তিনি বলেন, ‘আমাদের কেউ গুলি চালায়নি। গুলি চালিয়েছে কেরানীগঞ্জ পুলিশ। পুলিশ শ্রমিকদের পরিস্থিতি থামাতে ব্যর্থ হয়েছে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল নির্বাচনের আগে চক্রান্ত শুরু করেছে।’
কেন টোলের টাকা বাড়ালেন জানতে চাইলে ইজারাদার মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘সরকারিভাবে ইজারা নিয়ে টোল বাড়ানো হয়েছে। আগে ৩০টাকা ছিল সেটা একটি সিন্ডিকেট চালাত। ওই সিন্ডিকেট সরকারকে কোনো রাজস্ব দিত না। এখন সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। যেভাবে ইজারা হয়েছে একইভাবে কাগজে কলমে নির্দেশ এলে টোল নেওয়া বন্ধ হবে। তার আগে কারও কথায় টোল আদায় বন্ধ হবে না।’
গুলিবিদ্ধ আহত ও নিহতের ব্যাপারে জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জ ইকুরিয়া জেনারেল হাসপাতালের ম্যানেজার মো. কারিমুল হাসান বলেন, ‘তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে এসেছিলেন। একজনের বুকে গুলি লেগেছিল, যিনি মারা গেছেন। আর দুইজনের দুই পায়ে গুলি লেগেছে, তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’
গুলিবিদ্ধ দুইজনের একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সারাবাংলা ডট নেটের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সোহেল রানা জানিয়েছেন, পোস্তগোলা ব্রিজে গোলাগুলির ঘটনায় গুলিবিদ্ধ ৯ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এর আগে শুক্রবার (২৬ অক্টোবর) বেলা পৌনে ১২টার দিকে বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, কেরানীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ, শুভাঢ্যা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন ও তেঘরিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জজ মিয়া এসে টোলমুক্ত গাড়ি চলাচল করার ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
শুক্রবার বিকেলে শ্রমিক নেতা আলিমুদ্দিন জানান, গাড়ি চলাচল ুশুরু হয়েছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক আছে, তারপরও যদি টোল নেওয়া শুরু হয় তাহলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে যেতে পারে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ওই শ্রমিক নেতা।
সারাবাংলা/ইউজে/একে