Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গুরুত্ব হারিয়েছে পলিথিন নিষিদ্ধ আইন, বাড়ছে ব্যবহার


২৬ অক্টোবর ২০১৮ ২২:১৮

।। সাদ্দাম হোসাইন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণে বাংলাদেশে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল পলিথিনের ব্যবহার। নিত্য প্রয়োজনীয় এ বস্তুটির সহজলভ্য কোনো বিকল্প না থাকায় আইনটি তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে অভিজাত মার্কেটগুলোতেও সহজেই মিলছে ব্যবহার নিষিদ্ধ পলিথিন। ক্রেতা-বিক্রেতা কেউই অনাগ্রহ দেখাচ্ছে না নিষিদ্ধ বস্তুটি ব্যবহারে। এতে ক্রমেই বাড়ছে পলিথিনের ব্যবহার। ফলে পরিবেশের হুমকি থেকে সহসায় মিলছে না সমাধান। সেই সঙ্গে বাড়ছে নানান রোগ-ব্যাধীর পাশাপাশী মানবদেহে ক্যানসারের ঝুঁকি।

বিজ্ঞাপন

পরিবেশবিদরা বলছেন, আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং বিকল্প সহজলভ্য কোনো উপায় না থাকায় পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধের আইনটি দিনে দিনে তার গুরুত্ব হারাচ্ছে। সেই সঙ্গে মানুষও ক্রমান্বয়ে ভুলে যেতে বসেছে যে পলিথিন পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য চরম হুমকি।

তাই কোনো কাল বিলম্ব ছাড়াই পলিথিনের ব্যবহার রোধে বিকল্প সহজলভ্য উপায় বের করা এবং জনসচেতনা বৃদ্ধি ও আইনটি কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন পরিবেশবিদরা।

তবে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, তারা নিষিদ্ধ এ বস্তুটি ব্যবহার রোধ ও উৎপাদন বন্ধে প্রতিনিয়ত অভিযান ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। কিন্তু তা বাস্তবে যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন পরিবেশ রক্ষায় কাজ করা কর্মীরা। তারা বলছেন, নগরীতে কয়েক বছর আগেও পলিথিন ব্যবহার একেবারেই রোধ না করা গেলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে এর ব্যবহার বেড়েছে বহুগুণ। যেকোনো নিত্য প্রয়োজনী কাজ থেকে শুরু করে অপ্রয়োজনীয় কাজেও ব্যবহৃত হচ্ছে ব্যবহার নিষিদ্ধ বস্তুটি। আর এটি নিয়ন্ত্রণের বিপরীতে ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় মূল কারণ হিসেবে পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের উদাসীনতা ও উৎপাদনকারীদের সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগসাজস বলে মনে করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, দেশে আশির দশকে প্রথম পলিথিনের শুরু হয়। এরপর মাত্র ১৫ থেকে ২০ বছরে এর ব্যবহার এত বেড়েছে যে এটি পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়ায়। যে কারণে পরিবেশ রক্ষায় ২০০২ সালের জানুয়ারী থেকে এটি ব্যবহার, উৎপাদন ও পরিবহন করাকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। আইনটি বাস্তবায়ণে শুরুর দিকে কঠোর হলেও ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে পড়ে এর প্রয়োগ। ক্রমেই আইনটির প্রয়োগ শিথিল হতে হতে এখন বোঝার কোনো উপায়ও নেই যে দেশে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ। হারহামেশাই ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ এ বস্তুটি। যেকারণে পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থ ডে নেটওয়ার্ক বলছে, প্লাস্টিকের কারণে পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশের অবস্থান দশম।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) বলছে, রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি পলিথিন একবার ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া হয়। কারণ পলিথিন ব্যবহারে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং এটি একেবারেই সহজলভ্য বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিক্রেতারা যেকোনো পণ্যের সঙ্গে ক্রেতাদেরকে দিচ্ছে বিনামূল্যে। সেই সঙ্গে এমন পরিস্থিতিতে আইনের কঠোর প্রয়োগ না থাকায় নগরীর পুরান ঢাকায় এখনও নিষিদ্ধ এ পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ছোট-বড় তিনশটি কারখানায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন সারাবাংলাকে বলেন, প্লাস্টিক থেকে পলিথিন উৎপাদন হয়। আর প্লাস্টিক হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকে। নিঃশেষ হয় না। যে কারণে পলিথিনেরও একই কার্য ক্ষমতা। যেটি মাটিতে চাপা পড়লে গলেও না পচেও না। এতে মাটির জন্য পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছে সেগুলো চলাচলে বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে মাটির গুনগত মান নষ্ট হয়ে যায়। এতে ফলস উৎপাদনে উপযুক্ত ফল পাওয়া যায় না।

তিনি আরও বলেন, পলিথিন বা প্লাস্টিক থেকে সৃষ্ট টক্সিক রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে মিশে যায়। আবার সে মাটি বৃষ্টির মাধ্যমে পানির সঙ্গে নিঃসৃত হয়ে খাল বিল ও নদী নালা এবং সাগরে থাকা মাছের পেটে যাচ্ছে। আর সে মাছের কারণে মানবদেহের জন্য মারাত্মক হুমকি টক্সিক রাসায়নিকটা পশুপাখি ও মানবদেহে প্রবেশ করে। এতে নানান রোগব্যাধীর পাশাপাশি বাড়ে ক্যান্সারের ঝুঁকি। তাই এটি যত দ্রুত সম্ভব পুরোপরি বর্জন করা না হলেও অন্তত এটি নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানান তিনি।

সরেজমিনে রাজধানীর নিউ মার্কেট, কাওরান বাজার, কাপ্তান বাজার, মোহাম্মপুর কৃষি বাজার, খিলগাঁও কাঁচা বাজার, যাত্রাবাড়ি এবং শনির আখড়া কাঁচা বাজারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মার্কেটগুলো এবং বাসাবাড়ির অলিগলি ঘুরে দেখা যায়, সর্বত্রই চলছে পলিথিনের ব্যবহার। কিন্তু এটি যে ব্যবহার নিষিদ্ধ সে বিষয়ে ক্রেতা বিক্রেতা কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। যেকোনো পণ্যের বিপরীতে সহজেই বিনামূল্যে মিলছে পলিথিন। যেসব পণ্য বহন করতে পলিথিনের ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই সেসব পণ্যের ক্ষেত্রেও বিক্রেতারা ক্রেতাদেরকে পলিথিন দিচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের কাছে পলিথিনের বিকল্প কোনো কিছু মিলছে না।

কাওরান বাজারের একজন খুচরা সবজি বিক্রেতা রিয়াজ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এক কেজি পলিথিন দেড়শ টাকা দিয়ে কিনলে সেখানে ৫ শ থেকে ৬ শ পলিথিন থাকে। কিন্তু এক কেজি কাগজের ঠোঙ্গা ৪০ টাকা দিয়ে কিনলে সেখানে থাকে ৬০ থেকে ৭০টা। তো হিসেব করে দেখলাম পলিথিনই অনেক লাভ। আবার অনেক কাস্টমার আছে যারা পলিথিনে না দিলে নিতেই চাই না। আবার আমাদের অনেক সবজি আছে যেগুলোকে কিছুক্ষণ পরপর পানি ছিটাতে হয়। কিন্তু এসব সবজি কাগজের ঠোঙ্গায় দিলে তা বাসায় নেয়ার আগেই ছিঁড়ে যাবে। তাই পলিথিনই ভালো।

রামপুরায় বিভিন্ন বাসাবাড়ির অলিগলিতে বিভিন্ন ধরণের ফলমূল বিক্রি করেন খুচরা বিক্রেতা নুর মোহাম্মদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কাস্টমাররা ঠোঙ্গায় নিতে চাই না। ঠোঙ্গা নাকি ওজন বেশি। তাই পলিথিন দিয়ে ফল বিক্রি করি। কারণ পলিথিন ছাড়া এখনও অল্পদামে কোনো কিছু বাজারে পাই না আমরা। তাই কাওরান বাজার থেকে দুই তিন কেজি পলিথিন কিনে আনি। তবে এসব পলিথিন পুরান ঢাকার চকবাজার, ইসলামবাগ, বংশালসহ আশপাশের এলাকায় বানানো হয় বলে জানান তিনি। সরেজমিনে এসব এলাকা ঘুরেও দেখা মিলেছে এর প্রমাণ। তবে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

পবার সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুস সোবহাস সারাবাংলাকে বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধের আইন হওয়ার পর এটি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ হয়েছিল। ২০০৮-০৯ এর দিকে তা দেখাও গেছে কিন্তু পরবর্তিতে এটি বাস্তবায়ণ কিংবা আইনটির প্রয়োগে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা দেখিনি পরিবেশ অধিদপ্তরের। তার মতে, তাদের উদাসিনতার কারণে ক্রমেই এ আইন বিলুপ্ত হচ্ছে। আর চরম হুমকীতে পড়ছে পরিবেশ ও মানবদেহ।

তিনি আরও বলেন, গত কয়েক বছরে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে তেমন কোনো অভিযান বা আইন প্রয়োগে কার্যকরী উদ্যোগ চোখে পড়েনি। কিন্তু কেনো তারা তা করছে না সেটিও আমার কাছ বোধগম্য নয়। কারণ আমি যখন দায়িত্ব ছিলাম তখন বিডিআর নিয়ে পুরান ঢাকা অভিযান পরিচালনার মত ঘটনাও ছিল। এখন তারা যদি কার্যকরী উদ্যোগ নেয় তবে যেকোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে সফল অভিযান চালাতে পারবে। বর্তমানে পলিথিনের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর দায়ী বলে মনে করেন তিনি।

তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বায়ুমান ও ব্যবস্থাপনা) মো. তাজমিনুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, বিকল্প কোনো সহজলভ্য উপায় না থাকায় পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। তবে আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান করে এটির উৎপাদন বন্ধে কাজ করছি। সেই সঙ্গে জনসচেতনা বাড়াতেও কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। পলিথিন ব্যবহার রোধে বড় বড় গ্রুপ অব কোম্পানিগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। তবে পুরান ঢাকায় অভিযান পরিচালনা করতে গেলে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। তবুও অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান তিনি। তবে পলিথিন উৎপাদনকারীদের সঙ্গে সংস্থার কর্মকর্তারা জড়িত থাকার অভিযোগটি সত্য নয় এবং কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

সারাবাংলা/এসএইচ/এমআই

পলিথিন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর