Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মেয়েটি এখন কোথায় যাবে?


২৭ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:৪৭

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।

ঢাকা: বাবা নাই, মা নাই, ভাই- বোন কেউ নাই। মনে অনেক দুঃখ, মনের ভেতরে ব্যথা লাগে-নিচের দিকে তাকিয়ে এক হাত দিয়ে আরেক হাত ধরে রেখে কথাগুলো বলছিলেন ১৫ বছরের নীলুফার ( ছদ্মনাম)। তিনি ভাগ্য বদলের আশায় জর্ডান গিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অবশেষে দেশে ফিরে এসেছেন।

সুনামগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটও ও হাসপাতালের বেডে বসে খুব নিচু স্বরে নিজের জীবনের অবর্ণনীয় কথাগুলো বলছিলেন নীলুফার। তিনি এখন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তত্ত্বাবধায়নে রয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মেয়েটির বয়স ১৫ বছর হলেও পাসপোর্টে তার বয়স লেখা ছিল ২৭ বছর। বাবা-মা হারানো মেয়েটি বড় হয়েছিল দূর সর্ম্পকের এক চাচার কাছে। কিন্তু সেই চাচা তাকে গত বছরের ১২ জুন মাসে জর্ডান পাঠান। প্রথম দুই মাসের বেতন না পেলেও এরপর থেকে চাচার কাছে মেয়েটি নিয়মিত টাকাও পাঠান। কিন্তু সেই টাকার কথা এখন অস্বীকার করছেন তার চাচা, নিতে চাইছেন না মেয়েটির দায়িত্বও।

ব্র্যাকের তথ্য কর্মকর্তা আল আমিন নয়ন সারাবাংলাকে বলেন, মেয়েটি দেশে ফিরে বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কাছে জানান, তিনি আর চাচার কাছে ফিরতে চান না। তার ভয়, চাচা তাকে আবার বিদেশ পাঠিয়ে দেবে।

নীলুফার তাদের জানান, চাচার কাছে গেলে সে আবার বিদেশ পাঠাবে আর টাকা চাইতে গেলে তাকে মারধর করবে, সে ভয়ে নীলুফার একটি নিরাপদ আশ্রয় চান তাদের কাছে। পরে বিমানবন্দরের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রবাসীকল্যাণ ডেস্ক বিষয়টি জানালে তাকে ব্র্যাকের লার্নিং সেন্টারে রাখা হয়। কিন্তু সেখানে মেয়েটি আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

বিজ্ঞাপন

আল আমিন নয়ন বলেন, প্রথমে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও সেখানে দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে মেয়েটি। পরে গত ২১ অক্টোবর তাকে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। তারপর দিনই মেয়েটির জন্য মেডিকেল বোর্ড গঠন করে তার চিকিৎসা শুরু করেন চিকিৎসকরা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে মেয়েটির চিকিৎসায় থাকা দায়িত্বরত চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশে থাকা অবস্থায় মেয়েটি শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন। বিদেশে থাকা অবস্থায় চাচার কাছে টাকা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দেশে ফেরত আসার পর চাচা তাকে নিতে চান নাই, টাকা ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে-এটাও তার জন্য বড় ধাক্কা, সবকিছু মিলিয়ে সে এসব ধাক্কা সামলাতে পারেননি।’

মেয়েটির অসুস্থতাকে ‘একুইট স্ট্রেস রিঅ্যাকশন’ বলেই প্রাথমিকভাবে তারা ডায়াগনোসিস করেছেন। তার চিকিৎসা চলছে, তবে আগের চেয়ে তিনি অনেক সুস্থ। কিন্তু সুস্থ হয়ে মেয়েটি কোথায় যাবে-সেটি এখনও জানা যায়নি। এতিম এ কিশোরীর দায়িত্ব কে নেবে তা নিয়েও রয়েছে সংশয়।

জানা যায়, গত ২১ অক্টোবরেই প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক মো. তানভীর হোসেন নীলুফারের বিস্তারিত জানিয়ে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর মহাপরিচালকের কাছে চিঠি দেওয়া হয়। সে চিঠির অনুলিপি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ও সচিবের একান্ত সচিব এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী বরাবর দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে মেয়েটি বাংলাদেশ থেকে বিএমইটির ছাড়পত্র নিয়ে বৈধভাবে গিয়েছিল বলেও উল্লেখ করা হয়।

বিজ্ঞাপন

সেদিনই ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের উপ-সচিব, পরিচালক ( প্রশাসন ও উন্নয়ন) মো. জহিরুল ইসলাম  নীলুফারকে তার পরিবার অথবা নিকট আত্মীয়ের কাছে হস্তান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য চিঠি দেন সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও জগন্নাথপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে।

আরও পড়ুন: বিদেশে নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে সরকার উদ্বিগ্ন

প্রবাসী নারী শ্রমিক, জর্ডান ফেরত, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, শারীরিক ও যৌন নির্যাতন

চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে জর্ডানে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ও সচিবের একান্ত সচিব এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের সহকারী পরিচালক এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত সহকারী বরাবর।

কিন্তু এতদিন পার হলেও সে চিঠির বিষয়ে বা নীলুফারকে তার পরিবার অথবা আত্মীয়ের কাছে হস্তান্তরের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।

প্রায় প্রতিদিন বিদেশে থেকে নারীরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ফেরত আসছে, কিন্তু তাদের পাশে  নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কোথায়, এতে এত যে বেসরকারি সংস্থা, সেফ হাউজ রয়েছে তারাই বা কোথায় আজ? বলে প্রশ্ন করেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান। তিনি বলেন, ‘ব্র্যাক কতদিন এ দায়িত্ব একা পালন করে যাবে?’

শরিফুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘কতদিন আমাদের এ দায়িত্ব পালন করব। বিমানবন্দরের পুলিশ, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড আমাদেরকে জানানোর ওই মেয়েটিকে রাখি। কিন্তু সেখানে তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কিন্তু যদি কিছু হয়ে যেত-তাহলে এর দায় দায়িত্ব কে নিত। হাসপাতালেও তিনি একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেন-এর দায়িত্ব নেওয়া কী একা ব্র্যাকের কাজ?’

‘যত মেয়ে আসে তাদেরকে রাখা, বাড়ি পৌঁছে দেওয়া- এ দায়িত্ব কী শুধু আমাদের বা শুধু ব্র্যাকের বলে প্রশ্ন রেখে ক্ষোভ নিয়ে শরিফুল হাসান বলেন, ‘এখানে কী আর কারও কোনো দায়িত্ব নেই। যে সরকার তাকে পাঠিয়েছিল, তাকে অনুমোদন দিয়েছিল-তাদের ভূমিকা কোথায়? নারী শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করেন –তারাই বা কোথায়?’

আরও পড়ুন: যৌন নির্যাতনের শিকার অভিবাসী নারী শ্রমিকরা

‘নারী কর্মীদের যেহেতু পাঠানো হচ্ছে, তাহলে একটা ম্যাকানিজম তো রাষ্ট্রের থাকতে হবে যে, তারা নির্যাতিত হয়ে ফেরত এলে তাকে কীভাবে রাখা হবে, কিংবা অসুস্থ হয়ে এলে তার চিকিৎসা কোথায় হবে, কারা করবে-গর্ভবতী হয়ে এলে কোথায় রাখা হবে তাকে।’

যদি আমরা আমাদের নারীদের পাঠাই-তাহলে এ রকম বিপদ হলে কী করতে হবে সেটাও দরকার, কারণ এ ধরনের ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। আর এটা একার কারও কাজ না উল্লেখ করে শরিফুল বলেন, সম্মিলিতভাবে সবার একসঙ্গে কাজ করতে হবে, এদের জন্য ‘ওয়ে আউট’ করতে হবে। নয়তো একা ব্র্যাকের পক্ষে এসব কাজ করা কঠিন।

নয়ত এই মেয়েটির মতো অন্য নারীরা কোথায় যাবে-তাদের দায়িত্ব কে নেবে বলেও প্রশ্ন রাখেন শরিফুল।

সারাবাংলা/জেএ/একে

জর্ডান ফেরত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট প্রবাসী নারী শ্রমিক শারীরিক ও যৌন নির্যাতন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর