উপস্থিতির ইতিহাস গড়ে শেষ হলো দশম জাতীয় সংসদ
২৯ অক্টোবর ২০১৮ ২২:১৩
।। নৃপেন রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সরকারি ও বিরোধী দলের উপস্থিতির রেকর্ড গড়ে শেষ হলো দশম জাতীয় সংসদ। সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের রেকর্ডময় উপস্থিতির নজির স্থাপন করে বর্তমান দশম জাতীয় সংসদের সমাপ্তি হয়। সোমবার (২৯ অক্টোবর) রাত ১০টায় শেষ হয় এই সংসদের শেষ অধিবেশনের শেষ কার্যদিবসের সব কার্যক্রম।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সাবেক বিরোধী দল বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে দশম জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। শুরু থেকেই এই সংসদকে অবৈধ বলে দাবি করে আসছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সাবেক বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল। কিন্তু সব আলোচনা-সমালোচনার পথ মাড়িয়ে রেকর্ডময় উপস্থিতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দশম জাতীয় সংসদ।
২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে প্রথমারের মতো টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করার অনন্য নজির স্থাপন করে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী অন্যতম দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে চিহ্নিত জামায়াত ইসলামের অনুপস্থিতিও এই সংসদ ইতিহাসের পাতায় অনন্য হয়ে থাকবে।
দশম জাতীয় সংসদের উল্লেখযোগ্য আরও অর্জন হলো দু’টি আন্তর্জাতিক সংসদীয় ফোরামের প্রধান হিসেবে বাংলাদেশি কারও নেতৃত্ব পাওয়া। এর মধ্যে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিইউ) সভাপতি এবং সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সভাপতি নির্বাচিত হন। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়। এর ধারাবাহিকতার বৈশ্বিক ফোরাম দুইটির সম্মেলনও বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়। তবে দশম জাতীয় সংসদ প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ কয়েকজন সদস্যকে হারান। পরবর্তীতে শূন্য হওয়া আসনগুলোতে উপনির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সদস্য নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ জন সংসদ সদস্য বিনা ভোটে নির্বাচিত হন, যা দেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইতিহাসে প্রথম নজির। এই সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২৯ জানুয়ারি। আর শেষ হচ্ছে ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর। দশম জাতীয় সংসদে মোট ২৩টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।
এর মধ্যে ২০১৪ সালে চারটি, ২০১৫ সালে চারটি, ২০১৬ সালে পাঁচটি, ২০১৭ সালে পাঁচটি ও ২০১৮ সালে পাঁচটি অধিবেশন বসে। প্রথম অধিবেশনের কার্যদিবস ছিল ৩৬দিন, দ্বিতীয় অধিবেশনে ২৩ দিন, তৃতীয় অধিবেশনে ১৪ দিন, চতুর্থ অধিবেশনে ১০ দিন, পঞ্চম অধিবেশনে ৩৯ দিন, ষষ্ঠ অধিবেশনে ২৬ দিন, সপ্তম অধিবেশনে আট দিন, অষ্টম অধিবেশনে ১২ দিন, নবম অধিবেশনে ২৭ দিন, দশম অধিবেশনে ৯ দিন, একাদশ অধিবেশনে ৩২ দিন, দ্বাদশ অধিবেশনে ১০ দিন, ত্রয়োদশ অধিবেশনে পাঁচ দিন, চতুর্দশ অধিবেশনে ৩২ দিন, পঞ্চদশ অধিবেশনে পাঁচ দিন, ষোড়শ অধিবেশনে ২৪ দিন, সপ্তদশ অধিবেশনে ৫দিন, অষ্টদশ অধিবেশনে ১০ দিন, ঊনবিংশ অধিবেশনে ৩৫ দিন, ২০তম অধিবেশনে ৫দিন, ২১তম অধিবেশনে ২৫ দিন, ২২তম অধিবেশনে ১০ দিন ও ২৩তম অধিবেশনে কার্যদিবস ছিল আট দিন। সব মিলিয়ে দশম জাতীয় সংসদের মোট কার্যদিবস ছিল ৪১০টি।
এর আগে, নবম সংসদের ৪১৮ কার্যদিবসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন ৩৩৬ দিন। আর তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১০ দিন। আর দশম সংসদে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩৩৮ দিন উপস্থিত ছিলেন। আর বিরোধী দলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ উপস্থিত ছিলেন ২৪১ দিন। এর আগে কোনো বিরোধী দলীয় নেতা কখনই এতদিন সংসদে উপস্থিত থাকার নজির স্থাপন করেননি।
চলতি দশম সংসদে ১৯৮টি বিল পাওয়া যায়। রোববার সংসদের ৪০৯তম কার্যদিবস পর্যন্ত বিল পাস হয়েছে ১৯১টি। শেষ কার্যদিবসে আরও দুইটিসহ মোট ১৯৩টি বিল পাস হয়েছে এই সংসদে। বাকি পাঁচটি বিলের মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে চারটি বিল, একটি বিল অনিষ্পন্ন রাখা হয়েছে। এছাড়া দশম সংসদে ১৬টি বেসরকারি বিল পাওয়া যায়। এর মধ্যে আটটি বেসরকারি সদস্যদের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটিতের নিষ্পত্তি করা হয়। এই অধিবেশনে একটিও বেসরকারি বিল পাস হয়নি।
দশম সংসদে সংসদ সদস্যদের মধ্যে উপস্থিতিতে এগিয়ে কুমিল্লা-৭ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ ও কুমিল্লা-১ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সুবিদ আলী ভূইয়া। আওয়ামী লীগের এই দুই সংসদ সদস্য গত ২২তম অধিবেশন পর্যন্ত ৩৭৮ দিন করে উপস্থিত ছিলেন। এই অধিবেশনের আট দিন উপস্থিত থাকলে তাদের উপস্থিতি হয় ৩৮৬ দিন।
দশম সংসদ আরেকটি কারণে ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে। সেটা হচ্ছে— এই সংসদে আট কার্য দিবসে ১৯টি বিল পাস, যা আগের কোনো অধিবেশনেই সম্ভব হয়নি। সবশেষ ২৩তম অধিবেশনের আট কার্যদিবসে এই ১৯টি বিল পাস হয়।
দশম সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি তিন বার ওয়াক আউট করে। যদিও তাদের ওয়াক আউট ছিল অল্প সময়ের জন্য। এর মধ্যে একবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে, আরেকবার গ্যাস বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে, অন্যবার সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর বিল উত্থাপনের সময়।
এই সংসদে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিল পাস হয়। পাস হওয়া উল্লেখযোগ্য বিলের মধ্যে রয়েছে— বিচারপতিদের অভিসংশনের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে ষোড়শ সংশোধনী বিল, ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল, সড়ক নিরাপত্তা বিল, সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ আরও ২৫ বছর বাড়িয়ে সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) বিল, আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) সংশোধন বিল, দুর্নীতি দমন কমিশন বিল, মেট্রোরেল বিল, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার ও সংসদ সদস্যদের ভাতা বাড়ানো সংক্রান্ত বিল, মানবদেহে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন বিল।
দশম জাতীয় সংসদের ২৩তম অধিবেশনের শেষ কার্যদিবসের কার্যক্রম শুরু হয় সোমবার বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে শুরু হয় দশম সংসদের এই শেষ অধিবেশন।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর