সামাজিক সমাধান না পেয়ে নবজাতক ডাস্টবিনে, রাস্তার ধারে!
৩১ অক্টোবর ২০১৮ ০৮:৫০
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পদ্মার চরে ব্যাগের ভেতর থেকে এক নবজাতকের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। রোববার (২৮ অক্টোবর) বিকেলে চর সাদীপুর ইউনিয়েনের ঘোষপুর গ্রাম সংলগ্ন পদ্মা নদীর চরে ব্যাগটি পড়ে ছিল।
এর আগে, গত ২৩ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলার দেবিদ্বার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভেতরে থাকা ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা হয় এক নবজাতকের ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ। এরও আগে, গত ১৬ এপ্রিল রাজধানীর মহাখালীর আইপিএস পুকুরের পাড় থকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে বনানী থানা পুলিশ। অনুমান করা হয়েছিল, নবজাতকটির বয়স মাত্র দু’দিন।
এছাড়া, চলতি বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুরে একটি কার্টনের ভেতর থেকে পুলিশ উদ্ধার করে এক নবজাতকের মরদেহ। একই মাসের ১৮ তারিখে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ ঘাট থানা পুলিশ উজানচর ইউনিয়নে রাস্তার পাশ থেকে কার্টনের ভেতর থেকে উদ্ধার করে আরেক নবজাতকের মৃতদেহ।
মানবাধিকার কর্মী ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মূলত সামাজিক অবক্ষয় ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাবের কারণেই ডাস্টবিনে নবজাতক শিশুদের ফেলে রাখা হচ্ছে। সেখান থেকে কদাচিৎ কাউকে জীবিত অবস্থাতে পাওয়া গেলেও বেশিরভাগ নবজাতকই মৃত্যুবরণ করে। একইসঙ্গে সামাজিক সমাধান না পেয়ে ডাস্টবিনে, রাস্তার ধারে নবজাতককে ফেলে ফেলে গিয়ে অনেকে দায় থেকে মুক্তির পথ খোঁজে।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ২০১৭ সালের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সে বছর অজ্ঞাত পরিচয়ের ২৪টি শিশুর মৃতদেহ পাওয়া যায়। এর ৯৯ শতাংশই ছিল নবজাতক (জন্মের পর থেকে ২৮ দিন বয়স)।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালে সারাদেশে নবজাতক উদ্ধার করা হয়েছে ১২টি, ২০১৫ সালে ২৪টি, ২০১৬ সালে ৯টি, ২০১৭ সালে ১৭টি এবং চলতি বছরের মে মাসের ১৫ দিনেই ২৮টি নবজাতক উদ্ধার করা হয়েছে।
এছাড়া, ২০১৪ সালে ৭ অজ্ঞাত নবজাতকের মরদেহ, ২০১৫ সালে ৫২, ২০১৬ সালে ২৮, ২০১৭ সালে ২৪ ও ২০১৮ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ২৭ নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। গত মে মাসের প্রথম পনের দিন ২৮ নবজাতককে ডাস্টবিনে পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ১৭টি নবজাতকই ছিল মৃত।
নবজাতক হত্যার এই অনাকাঙ্ক্ষিত ও অমানবিক ঘটনাগুলো সামাজিকভাবে এবং শিশু সুরক্ষা ও অধিকারের মূলনীতির আলোকে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচির সমন্বয়কারী ও শিশু অধিকার সংগঠক আব্দুল্লা আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় নানাভাবেই এখন আনাকাঙ্ক্ষিত শিশুর জন্মলাভের সংখ্যা বাড়ছে। এর কোনো সামাজিক সমাধান না খুঁজে নবজাতক শিশুহত্যার মাধ্যমে আমরা এ বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
প্রত্যেক নারী-পুরুষকে দায়িত্বশীল হয়েই নতুন শিশুকে পৃথিবীতে আনার কথা ভাবতে হবে এবং সেই শিশু সুরক্ষা ও বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে উল্লেখ করে আব্দুল্লা আল মামুন বলেন, তারপরও যদি আনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কোনো শিশুর জন্ম হয়, কোনো অবস্থাতেই তার ঠিকানা যেন রাস্তার পাশের ডাস্টবিন বা পরিত্যক্ত ব্যাগ না হয়। সীমিতসংখ্যক হলেও এখন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে এই শিশুদের লালন-পালনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এই শিশু নিবাসগুলো সম্পর্কে আরও বেশি বেশি প্রচার করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে আনাকাঙ্ক্ষিত শিশুর প্রতি আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনেরও প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন মামুন। তিনি বলেন, অনেক সময় শিশুর বাবা-মা লোকলজ্জার ভয়ে এই শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেন। মনে রাখতে হবে— যা কিছুই ঘটুক না কেন, শিশুর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে তার সমাধান করা যাবে না। কারণ তার জন্মের পেছনে তার নিজের কোনো ভূমিকা নেই। পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি শিশু মর্যাদা আর অধিকারে সমান— জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের এই মর্মবাণীর আলোকে সমাজ গঠনে রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা ও আইনি সহায়তা নিয়ে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, সামাজিক একটা পরিবর্তন হচ্ছে। তার মধ্যে প্রযুক্তির কল্যাণে বিবাহপূর্ব যৌন সর্ম্পক বেশি হচ্ছে। যার কারণে এ বিষয়টি এখন বেশি হচ্ছে। এটাকে প্রযুক্তির একটা কুফল বলেই মনে করি।
‘আনওয়ান্টেড প্রেগন্যান্সি’ এড়াতে নারীদেরই বেশি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, ছেলে-মেয়েদের সুশিক্ষিত হতে হবে, যেন আনওয়ান্টেড রিলেশন থেকে সুরক্ষা করা যায় নিজেকে। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই এখানে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, কালচারাল গ্লোবালাইজেশন বা সাংস্কৃতিক বিশ্বায়নের প্রভাব এটা। কিন্তু যেগুলো আমাদের দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খায় না, সেগুলোকে আমরা এড়াতে পারছি না। একইসঙ্গে ‘এক্সট্রা ম্যারাইটাল রিলেশন’ এবং বৈধভাবে সন্তান জন্মানোর পরও পরবর্তীতে সন্তান লালন-পালনের ক্ষেত্রে মতভেদের কারণে দেশে ডাস্টবিনে, রাস্তার পাশে বা হাসপাতালে নবজাতক শিশুদের পাওয়া যাচ্ছে।
এটি অন্যান্য দেশেও রয়েছে উল্লেখ করে তৌহিদুল হক বলেন, কিন্তু সেখানে এসব শিশুদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় যে ব্যবস্থা, সে ব্যবস্থা আমাদের দেশের চেয়ে অনেক উন্নত। এই শিশুদের বড় করার জন্য তাদের রাষ্ট্রীয় বাজেট তৈরি হয়।
আমাদের দেশেও শিশু যত্নকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু সেসব জায়গাগুলোতে মানসম্মত সেবার অভাব রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের দায়িত্ব এসব শিশুর পরিচর্যার দায়িত্ব নেওয়া। তাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব রয়েছে এই বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার। এই ধরনের অবস্থাকে কীভাবে মোকাবিলা করবে, সেগুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে এ নিয়ে গণসচেতনতাও তৈরি করতে হবে। তাহলেই এ সংখ্যা কমে আসবে বলে মত দেন তৌহিদুল হক।
সারাবাংলা/জেএ/এমআই