গণিত শিখে বিশ্ব জয়ের স্বপ্ন
৩ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:৪৬
।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা : শিক্ষাবিদরা মনে করেন, দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাতেই ছেলে-মেয়েদের বিজ্ঞানী কিংবা বিজ্ঞান গবেষক হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা শিক্ষার্থীদের গণিত ভীতি। মূলত প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গণিত ভীতি ঢুকছে স্কুল থেকেই। সেই কারণে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও উচ্চ শিক্ষাস্তরে বিজ্ঞানের ছাত্র কমে যাচ্ছে। ফলে কমছে বিজ্ঞানী কিংবা গবেষক হওয়ার সুযোগও।
শিক্ষা পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ১৯৯০ সালে মাধ্যমিকে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থী ছিল ৪২ দশমিক ৮১ শতাংশ। ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিকে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৪০ শতাংশে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০০১ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রায় ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ছিল বিজ্ঞান বিভাগের। ২০০৮ সালে ২৩ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০১৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ২২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ১৯৯০ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে ২৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ১৯৯৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল মাত্র ১৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এরপর ২০০২ সালে তা বেড়ে হয় ২৫ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ২০০৮ সালে ১৯ দশমিক ৪১ শতাংশ এবং ২০১৩ সালে তা নেমে আসে ১৭ দশমিক শূন্য ১ শতাংশে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক সম্মান পর্যায়ে এই সংখ্যা আরও কম। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০০৬ সালে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ছিল ১৭ শতাংশ; কিন্তু বর্তমানে তা কমে হয়েছে ১১ শতাংশ।
জাতীয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বাড়লেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে দেখা গেছে, গত আট বছরে বিজ্ঞানে শিক্ষার্থী কমার হার ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। অন্যদিকে ব্যবসা প্রশাসন ও ব্যবসা বিষয়ক অধ্যয়নে শিক্ষার্থী বাড়ছে প্রায় পাঁচগুণ এবং উচ্চ মাধ্যমিকে প্রায় দ্বিগুণ হারে এই বৃদ্ধি।
এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের উপায় কী? কী করে বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে বিদ্যালয়ে- সেই চিন্তা থেকেই প্রায় দেড় যুগ আগে শুরু হয় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গণিত চর্চার উৎসব। যার নাম ‘গণিত অলিম্পিয়াড’।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম ক’বছর এ বিষয়টিকে মানুষের কাছে পরিচিত করতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। গণিত যে উৎসবের কোনো অনুষঙ্গ হতে পারে অভিভাবকদের কাছে এটি ছিল রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে চট্টগ্রামের ছেলেম আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরীর স্বর্ণপদক জয় এই উৎসবকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। গণিত এখন শিক্ষার্থীদের কাছে দিন দিন জনপ্রিয় ও উপভোগ্য বিষয় হয়ে উঠছে।
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের অর্জন:
বাংলাদেশের গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির দেওয়া তথ্যমতে, প্রতিবছর সারাবিশ্বের নিবন্ধনকৃত সদস্য দেশগুলোর গণিতবিদদের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড (আইএমও) প্রতিযোগিতা। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো আইএমওতে বাংলাদেশের পক্ষে সামিন রিয়াসাত এবং নাজিয়া চৌধুরী ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন। ২০১২ সালের বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম সিলভার পদক অর্জন করেন ধনঞ্জয় বিশ্বাস। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে রোমানিয়ায় অনুষ্ঠিত গণিত উৎসবে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে স্বর্ণ পদক জয় করে চট্টগ্রামের ছেলে আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী। এরপরই মূলত অলিম্পিয়াডের পালে লাগে ফাগুন হাওয়া। বিষয়টি আমলে নিয়ে সরকারও এগিয়ে আসে এ উদ্যোগের পাশে।
পথ দেখিয়েছিল সামিন ও নাজিয়া:
গণিত অলিম্পিয়াডে আজকের যে স্বর্ণ জয়, তার পথটি তৈরি হয়েছিল ২০০৯ সালে। সে বছর সামিন রিয়াসাত ও নাজিয়া চৌধুরী অংশ নিয়ে ব্রোঞ্জ পদক জিতে নেন। পরের বছর সেই ধারাবাহিকতায় তারিক আদনান, ২০১১ সালে ধনঞ্জয় বিশ্বাস ব্রোঞ্জ পদক পান। ধনঞ্জয় বিশ্বাস ব্রোঞ্জ সন্তুষ্ট থাকলেও পরের বছর তিনি রৌপ্য পদক পান আর তার সহযোদ্ধা সৌরভ দাশ, নূর মোহাম্মদ শফিউল্লাহ পান ব্রোঞ্জ, ২০১৩ সালে আদীব হাসান ও সৌরভ দাশ ব্রোঞ্জ, ২০১৪ সালে আবরও ব্রোঞ্জ পান এ দু’জন, ২০১৫ সালে মোহাম্মদ সানজিদ আনোয়ার রৌপ্য ও আদীব হাসান, আসিফ ই এলাহী, মোহাম্মদ সাব্বির রহমান ও সাজিদ আখতার যৌথভাবে ব্রোঞ্জ পদক লাভ করেন।
২০০৫ সাল মোট ১৪টি আসরে অংশ নিয়ে ১টি স্বর্ণ, রৌপ্য ৬টি, ব্রোঞ্জ ২২টি ও ২৭টি সম্মানজনক স্বীকৃতি লাভ করে বাংলাদেশ।
অংশগ্রহণের ক্যাটাগরি:
আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে কেবল প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু দেশে গণিতকে জনপ্রিয় করার জন্য প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পর্যায়ে গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজন করা হচ্ছে। এই পর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। এগুলো হলো- প্রাইমারি (৩য় শ্রেণী-৫ম শ্রেণী), জুনিয়র (৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণী), সেকেন্ডারি (৯ম-এএসসি পরীক্ষার্থী), হায়ার সেকেন্ডারি (১১শ-১২শ শ্রেণী)।
রেজিস্ট্রেশনের নিয়ম:
সব আঞ্চলিক উৎসবে ‘আগে এলে আগে’ ভিত্তিতে মোট এক হাজার শিক্ষার্থীর রেজিস্ট্রেশন করার সুযোগ পাবে। বাংলা ও ইংরেজি উভয় মাধ্যমেই এটি প্রযোজ্য। ব্যক্তিগত পর্যায়ে যে কেউ অংশ নিতে পারবে, তবে রেজিস্ট্রেশন করার সময় শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র, বেতনের রসিদ, ফলাফলের বিবরণী কিংবা এসএসসি পরীক্ষার প্রবেশপত্র— যেকোনো একটি প্রমাণ হিসেবে দেখাতে হবে।
সম্ভাবনার আগামীর দিনগুলো:
গণিতকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপভোগ্য করতে এই উদ্যোগ শুরু হলেও উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন এসে দাঁড়িয়েছে আকাশ ছোঁয়ার। তারা বলছেন, গণিত ভীতি দূর করা গেলে দেশে একদিকে যেমন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বাড়বে, তেমনি বাড়বে আবিষ্কারের সম্ভাবনা। উন্নত দেশগুলোতে যেভাবে শিশুরা ছোট থেকেই বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পেছনে ছোটে, তেমনি আমাদের শিশুরাও ছুটবে। গতানুগতিক ধারার পড়ালেখা আর পাশ-ফেলের গণ্ডি পেরিয়ে কেউ কেউ নতুন নতুন আবিষ্কার দিয়ে বাংলাদেশকে একদিন অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, গণিতকে জয় করতে পারলেই আর কোনো পড়ালেখার দরকার হবে না। ওগুলো এমনিতেই হবে। আমাদের লক্ষ্য গতানুগতিক ধারার বাইরে শিক্ষার্থীদের কিছু করতে পারার সক্ষমতা অর্জন। সে জন্য গণিত শেখার কোনো বিকল্প নেই।
এগিয়ে এসেছে সরকার:
এতোদিন গণিত অলিম্পিয়াড ছিল কেবলমাত্র একটি গোষ্ঠীগত উদ্যোগ। কিন্তু চলতি বছর থেকে সেখানে যোগ হয়েছে সরকারের হস্তক্ষেপ। ইতোমধ্যে সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গণিত অলিম্পিয়াড কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের গাণিতিক দক্ষতা বৃদ্ধির সম্ভাব্যতা যাচাই নামে যে প্রকল্প হাতে নিয়েছে তাতে সারাদেশের ১৭টি জেলার ১৭টি উপজেলার ৮০টি স্কুল থেকে ৩ জন করে মোট ২৪০ জন শিশুকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। ১০টি ক্লাস্টারে বিভক্ত করে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পাঠদান হবে। সেখানে ক্লাস নেবেন গণিত অলিম্পিয়াডের মেন্টররা। সপ্তাহে একবার করে এসব স্কুলে একাডেমিক সুপারভিশন, প্রকল্পের বাস্তবায়ন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন ও পরিমার্জিতভাবে পাঠদান দেওয়া হবে। এরপর গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য বাছাইকৃতদের নিয়ে একটি ক্যাম্প করা হবে। সেই ক্যাম্পেই হবে গণিতের সর্বশেষ পরিচর্যা।
এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক মো. নুরুন্নবী জানান, প্রকল্পটি মূলত সারাদেশের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দেবে। গণিতে ভীতি কাটাতে পারলে যেমন বাবা-মায়ের লাভ, তেমনি সেটি পুরো জাতির জন্যও লাভজনক। ভবিষ্যতে প্রকল্প এলাকা বাড়বে বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলা/এটি