যৌন নির্যাতনের শিকার অভিবাসী নারী শ্রমিকরা
৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০৮:২১ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ১৮:৪৩
শামীম রিজভী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
‘সারাদিনে খালি এক বেলা খাইতে দিত, আর শুইতে দিতো বাথরুমের পাশে। গন্ধে সারা রাইত ঘুম আইতো না। সারাদিন কাম করাইতো। একটু ভুল হইলেই মাইর দিত। আমি যহন দূতাবাসে ছিলাম তহন অনেকেরেই দেখছি, যাগো মাইরা মালিকরা হাত-পা ভাইঙ্গা দিছে। আবার অনেকেরেই দেখছি গর্ভবতী হইয়া আইছে। এক মাইয়ারে তো অনেকবার অনেকজনের কাছে বিক্রিও কইরা দিছিলো।’
প্রবাসের দুঃসহ দিনগুলোর কথা এভাবেই সারাবাংলার কাছে বলছিলেন রহিমা খাতুন (৪৫)। সম্প্রতি সৌদি আরবে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে ঢাকায় ফিরেছেন তিনি।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে ২ ছেলে-মেয়ে আর স্বামী নিয়েই ছিল রহিমার ছোট সংসার । তবে সংসারে একটু স্বচ্ছলতার আর সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে মাস ছয়েক আগে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব যান তিনি। পূর্ব পরিচিত জনির কথায় গুলশানের আকবর এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে কাজের খোঁজে সৌদি আরব যান রহিমা। কিন্তু ফেরেন শূন্য হাতে, সঙ্গে হারান সাজানো সংসার। তার সঙ্গে আর সংসার করতে চায় না স্বামী।
রহিমা সারাবাংলাকে জানান, সৌদি আরবে পৌঁছানোর পর তাকে একটি বাসায় গৃহপরিচারিকা হিসেবে কাজ দেওয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পর বাসার মালিক রহিমার পাসপোর্ট নিয়ে যায়, যাতে করে তিনি পালাতে না পারেন। রহিমা দিনে এক বেলা ‘ঝুটা খাবার’ খেয়ে, টয়লেটের পাশে শুয়ে, সব নির্যাতন সহ্য করে দিন কাটাতে থাকেন শুধু একটি সুযোগের আশায়। একদিন যখন তিনি সে সুযোগ পান তখন ওই বাসা থেকে পালিয়ে যান।
রহিমা বলেন, ‘আমার দেড়টা লাখ টাকাই পানিতে গেল। সৌদি আরবে ৬ মাস থাকনের পর দেশে আইতে পারলাম। এহনও অনেকে দূতাবাসে আছে। ২০০-২৫০ জনের মত গর্ভবতী মাইয়াগো দেখছি। ওরা সবাই ঘরের কামের জন্য এহানে আইছিলো। কিন্তু মালিকরা ওগোরে গর্ভবতী বানাইয়া দূতাবাসে ছাইড়া দিয়া গেছে। অনেকে আবার পালাইয়াও আইছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এক মাইয়া আইছিলো। শরীরের অবস্থা ভালো আছিলো না অর। শরীরের জায়গায় জায়গায় মাইরের দাগ। ওর মালিক ওরে খালি একেকজনের কাছে কয়েক রাইতের লিগা বিক্রি কইরা দিতো। আমার লগেই দেশে ফিরছে। আরও অনেক মানুষরে দেখছি দূতাবাসে। মালিকরা কারও হাত-পা ভাইঙ্গা দিছে, কারও গায়ে গরম পানি ঢাইলা দিছে আরও অনেক ধরনের নির্যাতন করছে।’
বাংলাদেশ ফ্রি ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস (বিএফটিইউসি) সেক্রেটারি পুলক রঞ্জন ধর সারাবাংলাকে জানান, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বিদেশে যাওয়ার আগে শ্রমিকদের যে ব্রিফিং দেয় সেখানেও পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়ে কিছু বলা হয় না। ফলে শ্রমিকরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সময় নিজেদের নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কেও অসচেতন থেকে যাচ্ছেন। ২০১৩ সালে প্রণীত ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনের সপ্তম অধ্যায়ে’ শ্রমিকদের অধিকার হিসেবে তথ্য, আইনগত সহায়তা, দেওয়ানি মামলা দায়েরের সহায়তা, দেশে ফিরে আসার অধিকার এবং আর্থিক ও অন্যান্য কল্যাণমূলক অধিকারের জন্য বলা রয়েছে। কিন্তু সেখানে কর্মক্ষেত্রে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার অধিকারের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি।
পুলক রঞ্জন ধর জানান, বিদেশে যাওয়া শ্রমিকদের ৪২ শতাংশ দক্ষ কর্মী, এক শতাংশ পেশাজীবী, ১৬ শতাংশ আধা দক্ষ কর্মী এবং ৪১ শতাংশ কম দক্ষ কর্মী। তবে দক্ষ-অদক্ষ কোনো শ্রমিকেরই পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সম্পর্কে ধারণা নেই।
বাংলাদেশ অক্যুপেশনাল সেইফটি, হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক এ আর চৌধুরী রিপন সারাবাংলাকে জানান, মোট প্রবাসী শ্রমিকের ৫০ শতাংশ অদক্ষ এবং ১৫ শতাংশ অর্ধদক্ষ, যারা মূলত নির্মাণ শ্রমিক, গৃহকর্মী, কৃষি শ্রমিক ইত্যাদি কাজে নিয়োজিত। তাদের কর্মপরিবেশের অনিরাপত্তা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নিম্ন মজুরি, নিয়োগকারীর চাপ ইত্যাদির জন্য শ্রমিকদের দুর্ঘটনা, অসুস্থতা, এমনকি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তাপমাত্রাও বাংলাদেশি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ঝুকিপূর্ণ। মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যে সকল শ্রমিকরা অবৈধভাবে থাকছেন, তারা এখানে-ওখানে পালিয়ে অনেক ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছেন।
তিনি আরও জানান, নারী গৃহকর্মীরা অনেকেই অত্যধিক কাজের পাশাপাশি নিয়োগকারীর শারীরিক, মানসিক এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হন। কারো কারো ক্ষেত্রে বাসায় বন্দী করে রাখা এবং পাসপোর্ট আটকে রাখারও ঘটনা ঘটে। ২০১৭ সালে ৬৭ হাজার নারী গৃহকর্মী সৌদি আরব গিয়েছেন। ২০১৬ সালে ২৫০০ নারী গৃহকর্মী সৌদি আরবে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসের সেইফ হোমে আশ্রয় নিয়েছেন। এরা সবাই কাজের চাপ, বেতন না পাওয়া, যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার। নারী শ্রমিকদের পেশাগত নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে পাঠানো প্রতিবেদনটিও সরকার আমলে নেয়নি। অথচ ইন্দোনেশিয়ার সরকার সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে নারী শ্রমিকদের অভিবাসনকে সংকুচিত করেছে।
সারাবাংলা/এসআর/জেজএফ