অসর্তকতাতেই কাটা পড়েছিল রওশন আরার ডান কিডনি: তদন্ত কমিটি
৫ নভেম্বর ২০১৮ ২২:৪৬
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: অসর্তকতা ও অসাবধানতার কারণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) অস্ত্রোপচারের সময় রওশন আরার বাম পাশের কিডনির সঙ্গে ডান পাশের কিডনি কেটে ফেলা হয়েছে বলে জানিয়েছে এ ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি।
বিএসএমএমইউ উপ-উপাচার্য ডা. রফিকুল আলম জানিয়েছেন, এটা সার্জনের অজ্ঞতার কারণে হয়েছে, গাফিলতির জন্য হয়েছে নাকি তাৎক্ষণিক পরিস্থিতির কারণে হয়েছে এবং আইনের দৃষ্টিতে এ ঘটনাকে কিভাবে দেখা হবে— সে বিষয়গুলো আরও উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করে তাদের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সোমবার (৫ অক্টোবর) দুপুরে ওই ঘটনায় গঠিত তদন্ত প্রতিবেদন সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে ডা. রফিকুল আলম এসব কথা বলেন। এসময় তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হেলাফেলা করেনি, জানামাত্র তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সুপারিশ করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত তদন্ত কমিটির প্রধান ও জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুণ অর রশীদ বলেন, তদন্তে এ ঘটনা আমাদের কাছেও অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। তাই এ ধরনের কেস রির্পোট আমরা ইন্টারনেটে দেখতে চেয়েছি। কিন্তু সেখানে দেখা গেছে, এ ধরনের কোনো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি।
ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, আমরা সব ইনভেস্টিগেশন দেখেছি। তার (রওশন আরা) প্রথম আলট্রাসনোগ্রামে দু’টো কিডনিই ছিল। তবে সেখানে একটি কিডনি স্বাভাবিক থাকলেও আরেকটি কিডনি ফোলা ছিল। আবার সিটি স্ক্যান রিপোর্টে পাওয়া যায়, তার দু’টো কিডনি থাকলেও একটি হাইড্রো নেফ্রোটিক, অন্যটি অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। যেহেতু কিডনির ফাংশন স্বাভাবিক ছিল, সে হিসেবে আমরা আশা করেছিলাম, একটি কিডনি অস্ত্রোপচার করলে রোগী সুস্থ থাকবেন।
অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, এই রোগী ইনফেকটেড ছিলেন। আগে দুই বার তার কিডনি অস্ত্রোপচার হয়েছে। তাই কিডনিটা ইনফেকটেড ছিল। অস্ত্রোপচার টেবিলে তার রক্তক্ষরণ শুরু হয়, পুঁজ বেরিয়েছিল। তখন ইনফেকশন শরীরে ছড়িয়ে যায়। সে অবস্থায় রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য জীবন বাঁচানোটাই মুখ্য হয়ে যায়।
অধ্যাপক হারুন জানান, রওশন আরার দু’টি কিডনি থাকলেও কিডনির নিচের দিকটা কানেকটেড ছিল, যেটাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় হর্ষসু (ঘোড়ার ক্ষুরের আকৃতি) কিডনি বলা হয়। কিন্তু এটি আলট্রাসনোগ্রাম ও সিটি স্ক্যানে ধরা পড়েনি।
ডা. হারুন বলেন, এটা নিয়ে এখনও আমরা এখনও চিন্তা-ভাবনা করছি। এর ব্যাখ্যা বুঝতে পারছি না। যিনি অস্ত্রোপচার করেছেন, সে মুহূর্তে তার জীবন বাঁচানোর জন্য, রক্তক্ষরণ বন্ধ করার জন্য, পুঁজ রিমুভ করার জন্য হয়তো বাম কিডনির সঙ্গে ডান কিডনি চলে এসেছে। তখন অ্যাকুইট কিডনি ফেইলিউর হয়, যেটা অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক বুঝতে পেরেছেন কি না, আমি জানি না। পরে ইনফেকশন শরীরে ও মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যায়, যাকে বলা হয় Disseminated intravascular coagulation (DIC)। পরে ব্রেইন স্ট্রোক হয়, একইসঙ্গে ডিআইসি’র মারাত্মক জটিলতা তৈরি হলে তার মৃত্যু হয়। কিডনি ফেইলিউর হয়ে রোগী মারা গেছেন বলে আমি বিশ্বাস করি না।
অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি মারা গেছেন। এ জন্য আমরা দুঃখিত, মর্মাহত। এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যেন আর না ঘটে, সেজন্য চিকিৎসকদের আরও বেশি সর্তক হওয়া উচিত। কিন্তু চিকিৎসকরা সতর্ক থাকা সত্ত্বেও মেডিকেল সায়েন্সে এমন কিছু ঘটে যায়, যেটার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ কী, বিশ্ববিদ্যালয় এ ঘটনায় কাউকে চিহ্নিত করেছে কি না কিংবা কাউকে শাস্তি দেবে কি না— জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগে চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ কে এম খুরশিদুল আলম বলেন, এই তদন্ত কমিটি কারও অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে হয়নি। গণমাধ্যমে প্রতিবেদন দেখে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্ত প্রতিবেদনে আমরা দিয়েছি, বাম কিডনি অস্ত্রোপচারে সঙ্গে ডান কিডনি অপসারণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়াকে এ প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
তদন্ত কমিটির আরেক সদস্য, ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আমানুর রসুল বলেন, আমাদের দেখার বিষয় ছিল বাম পাশের কিডনি ফেলা হয়েছে কি না। আমরা বলেছি, ফেলা হয়েছে। একইসঙ্গে ডান পাশের কিডনিও অপসারিত হয়েছে বলে স্বীকার করেন এই অধ্যাপক।
ডান পাশের কিডনি অপসারণ স্বাভাবিক কি না— জানতে চাইলে ঢামেক হাসপাতালের এই অধ্যাপক বলেন, জন্মগতভাবে তার ‘হর্স শু’ কিডনি ছিল। অস্ত্রোপচার কক্ষে তার রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। সার্জনের উদ্দেশ্য ছিল, তার জীবন বাঁচানো, কোনো অর্গান (অঙ্গ) বাঁচানো নয়। প্রচুর রক্তক্ষরণ, আগের অস্ত্রোপচার এবং অন্যান্য অ্যাডিশনের কারণে সেটা কিডনি কি না— সেটা বোঝা অসম্ভব ছিল। ওই সময় সার্জন যেটা করেছেন, সেটা ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না।
উল্লেখ্য, গত ৫ অক্টোবর রওশান আরা নামের এক রোগীর বাম পাশের কিডনি অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে ডান পাশের কিডনিও ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার ছেলে রফিক সিকদার। পরে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে এবং সেই তদন্ত কমিটির সদস্যরা আজ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। মৃত রওশন আরার ময়নাতদন্ত হয় গত ৩ নভেম্বর।
ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, মৃতদেহের শরীরে কোনো কিডনি পাওয়া যায়নি।
জাতীয় কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইন্সটিটিউট এর চিকিৎসক সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদকে সভাপতি করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আরও ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম খুরশিদুল আলম, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. জুলফিকার রহমান খান, নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আছিয়া খানম, রেডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. ইকবাল হোসেন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইউরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আমানুর রসুল।
আরও পড়ুন-
চিকিৎসকের ‘অসর্তকতায়’ ২টি কিডনিই হারালেন রোগী!
মারা গেলেন দুই কিডনি হারানো সেই মা, ছেলে যাবেন আদালতে
সারাবাংলা/জেএ/টিআর