আয়কর বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৩ সুপারিশ দুদকের
৮ নভেম্বর ২০১৮ ২০:২১
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধে ১৩টি উৎস চিহ্নিত করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। একইসঙ্গে এসব দুর্নীতি প্রতিরোধে ২৩ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার (৮ নভেম্বর) এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট অনুমোদন করেছে দুদক। আর সেই রিপোর্টের সুপারিশমালা পাঠানো হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে। দুদকের একটি সূত্র সারাবাংলাকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্য ওই প্রাতিষ্ঠানিক রিপোর্ট তৈরি করেছে। কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব সারোয়ার মাহমুদের স্বাক্ষরে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের কাছে সুনির্দিষ্ট এই সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।
দুদকের সুপারিশগুলো হলো- আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান সব নাগরিক যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র রয়েছে তাদের প্রত্যেকের জন্য করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর গ্রহণপূর্বক আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করা। সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ টিমের মাধ্যমে কর বিভাগের জন্য এ যাবৎ প্রস্তুতকৃত অটোমেশন মডিউলগুলো পর্যালোচনা করে এগুলো হালনাগাদ করা এবং একইসঙ্গে লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ সফটওয়্যারগুলো বাতিল করে দেশীয় সফটওয়্যার ডেভেলপারদের মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী নতুন সফটওয়্যার প্রস্তুতের ব্যবস্থা নেওয়া।
ই-ট্যাক্স সিস্টেমকে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করে তা কার্যকর করে ‘কল সেন্টার’ ও ‘ট্যাক্স পেয়ার’স সার্ভিস সেন্টার’ প্রস্তুত করা। উৎসে কর ব্যবস্থাপনাকে জরুরি ভিত্তিতে অটোমেশনের আওতায় আনা এবং এর জন্য একটি পৃথক প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা।
সুপরিশের মধ্যে আরও আছে- অঞ্চলের কাজের সঙ্গে সংগতি রেখে ট্যাক্স অ্যাডমিনিস্ট্রিশন ক্যাপাসিটি অ্যান্ড ট্যাক্স পেয়ার সার্ভিসেস প্রকল্পের আওতায় টিআইআরএস পদ্ধতিতে বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন, ভূমি প্রশাসন ইত্যাদি সংস্থার সঙ্গে অনলাইনে সংযুক্তির মাধ্যমে তাদের ডাটাবেস ব্যবহার করে নতুন করদাতা শনাক্ত করার প্রক্রিয়া প্রবর্তন করা হয়। অথচ এই পদ্ধতিটি প্রবর্তনের পর ব্যবহার না করার জন্য এর সুফল প্রাপ্তি থেকে আয়কর বিভাগ বঞ্চিত হয়।
কেন্দ্রীয় জরিপ অঞ্চলকে একটি কর নির্ধারণী কর অঞ্চল হিসেবে ব্যবহার না করে এর উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সুস্পষ্ট নিদের্শনা এবং পরিপালনের নীতিমালা প্রবর্তনের মাধ্যমে টিআইআরএস সফটওয়্যারটি যুগোপযোগী করে ব্যবহারযোগ্য নতুন করদাতা শনাক্তকরণের কাজে লাগানো।
ট্রান্সফার প্রাইজিংয়ের কার্যক্রম একটি কর্তব্যনিষ্ঠ ও সৎ টিমের তত্ত্বাবধানে অবিলম্বে চালু করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। ইন্টারনাল অডিট পরিদফতরকে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী দফতরে পরিণত করার লক্ষ্যে অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে প্রতিপালন নিশ্চিতকরণ।
আয়কর বিভাগের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলসহ (সিআইসি) প্রতিটি দফতরের নথি নিষ্পত্তির জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খেয়াল-খুশিমত করদাতাদের কর মামলা অডিটের জন্য নির্বাচনের সুযোগ বন্ধ করণ এবং প্রচলিত নিরীক্ষার পরিবর্তে কম্পিউটারের সহায়তায় ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির আওতায় বস্তুনিষ্ঠ নিরীক্ষার প্রবর্তন।
বিদ্যমান কর আইনের জটিলতাসমূহ নিরসনপূর্বক নতুন যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন। এনবিআরের ওয়েবসাইটকে আরও ইন্টারঅ্যাক্টিভ ও করদাতাবান্ধব করার লক্ষ্যে সব পদ্ধতিকে আরও ডিজিটাল ও আধুনিক করা। আয়কর বিভাগের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আয়কর প্রদানকারী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শক হিসেবে কাজ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, যুগ্ম কর কমিশনার বা কর কমিশনাররা কর্তৃক আইন বহির্ভূত অনুমোদন প্রক্রিয়া বন্ধকরণ এবং এর অপব্যবহার রোধকল্পে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড হতে একটি সুস্পষ্ট নির্দেশনা জারি করতে হবে।
দুদকের সুপারিশে বলা হয়, আয়কর বিভাগে চলমান অটোমেশন প্রক্রিয়া দ্বারা কর সার্কেলে ব্যবহৃত অফিস প্রণালী অনুযায়ী রেজিস্টার সংরক্ষণ এবং তা ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালনাগাদ করতে হবে। এতে করে রেজিস্টার টেম্পারিংয়ের সুযোগ রহিত হবে এবং এ সংক্রান্ত দুর্নীতি বহুলাংশে হ্রাস পাবে। পূর্ণাঙ্গ অটোমেশন চালু হওয়ার পূর্বে সনাতন পদ্ধতিতে রেজিস্টার সংরক্ষণের যে পদ্ধতি বিদ্যমান রয়েছে তা যথাযথভাবে অনুসরণ এবং পরিদর্শী কর্মকর্তাগণ নিয়মিত ভিত্তিতে তাদের অধীন সার্কেলসমূহে এ রেজিস্টারসমূহ সঠিকভাবে হালনাগাদ হচ্ছে কি না তা পরীক্ষা করা। বিদ্যমান আয়কর আইনের বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কিছু ১৯ বিবিবিবিবি ও ১৯ ই(২)(ডি) তে বর্ণিত আয়ের উৎসের বৈধতার বিধান অনুসরণের নির্দেশনা প্রদান।
সুপারিশের মধ্যে আরও রয়েছে- পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদার করতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক কর পরিদর্শক নিয়োগ প্রদান, কর পরিদর্শক কর্তৃক প্রদত্ত রিপোর্ট পুনর্নিরীক্ষা করার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং উপ কর কমিশনার কর্তৃক সে সব রিপোর্টের সত্যতা দৈবচয়ন ভিত্তিতে যাচাই করার ব্যবস্থা গ্রহণ, কর পরিদর্শকের তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের পন্থা এবং এ সংক্রান্ত অনুসৃত বিধি-বিধান, মাঠ পর্যায়ে করদাতাদের সাথে রুলস অব অ্যাঙ্গেজম্যানট করতে ট্যাক্স ইন্সপেক্টর ম্যানুয়াল প্রণয়ন। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী সকল বৈধ প্রতিনিধিকে (চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট, অ্যাডভোকেট প্রমুখ) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে নিবন্ধিত হতে হবে।
সুপারিশে আরও রয়েছে- রাজস্ব সংলাপ আয়োজন খরচ, হালখাতা আয়োজনসহ করদাতা জরিপ ও স্পট অ্যাসেসমেন্ট প্রোগ্রামের খরচ বাজেট মঞ্জুরির মাধ্যমে সম্পন্ন করা, বছরব্যাপী আয়কর মেলা, আয়কর দিবস, রাজস্ব হালখাতা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানসমূহে জনসম্পৃক্ততা নিশ্চিতকল্পে সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুসরণ করে একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে বাস্তবায়ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ এবং উচ্চ আদালতে অনিষ্পন্ন রাজস্ব এবং আয়কর মামলাসমূহ নিস্পত্তির লক্ষ্যে প্রবর্তিত বিকল্প বিরোধ নিস্পত্তি ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী, যুগোপযোগী এবং কার্যকর করার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়ন।
আয়কর বিভাগের দুর্নীতির উৎস সম্পর্কে দুদক বলছে- ম্যানুয়াল প্রক্রিয়ায় আয়কর নথি গ্রহণ। নথি নিষ্পত্তি সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারিত নেই। নতুন করদাতা চিহ্নিতকরণে সংশ্লিষ্ট কর কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত অতিরিক্ত স্বেচ্ছামাফিক ক্ষমতাকে অনেকেই দুর্নীতি ও অনিয়মের অন্যতম উৎস বলে মনে করেন। সরেজমিনে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানা যায় নতুন করদাতা চিহ্নিতকরণের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর কর্মকর্তাদের মর্জির ওপর নির্ভরশীল।
দুদক বলছে, কর প্রণোদনা এবং কর মওকুফের ক্ষেত্রে আয়কর বিভাগের কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত স্বেচ্ছামাফিক ক্ষমতার কারণেও দুর্নীতি বাড়ছে। এছাড়াও আয়কর বিভাগের কতিপয় কর্মকর্তা কর্তৃক আইন, বিধি এবং নিয়মবহির্ভূত আয়কর প্রদানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অঘোষিত পরামর্শক হিসেবে কাজ করাও এর কারণ।
দুর্নীতির কারণগুলোর মধ্যে আরও আাছে- কর পরিদর্শক কর্তৃক প্রণীত পরিদর্শন রিপোর্টের সত্যতা দৈবচয়ন ভিত্তিতে যাচাই না করা। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট, আয়কর আইনজীবী প্রমুখ পেশাজীবীদের রাজস্ব বোর্ডে নিবন্ধিত না করা। নিরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ (সিএ ফার্ম) ও করদাতা প্রতিষ্ঠানের যোগসাশে প্রণীত অডিট রিপোর্ট জালিয়াতি। বদলি, পদায়নে প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণে শিথিলতা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে।
দুর্নীতির আরও কারণ হচ্ছে- আয়কর বিভাগের অভ্যন্তরে এবং আয়কর বিভাগের সঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীন কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বহির্ভূত সংশ্লিষ্ট বিভাগ বা দপ্তর যেমন- বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকারি ক্রয় সংশ্লিষ্ট বিভাগসমূহ, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক এর দপ্তর, ভূমি অধিদপ্তর, বিআরটিএ, আরজেএসসি,সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন,নির্বাচন কমিশন ইত্যাদির সাথে প্রাসঙ্গিক তথ্য আদান-প্রদান, যোগাযোগ, সমন্বয়, সহযোগিতার অভাব, অপ্রতুলতা আয়কর ফাঁকির সুযোগ সৃষ্টি করে যা প্রকারান্তরে দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে।
কেন্দ্রীয় জরিপ অঞ্চলে কোন আয়কর অধিক্ষেত্র নেই। এর মূল কাজ হচ্ছে নতুন করদাতা, শনাক্ত করে তা সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলে আয়কর নথি খোলার জন্য প্রেরণ করা। আয়কর নথির হিসাব না থাকায় এ কর অঞ্চলে প্রকৃত আয়কর নথির সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয়না। আয়কর মেলার প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রয়োজন রয়েছে তবে আয়কর মেলার নামে বিলাসবহুল প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে অর্থ ব্যয়ে অস্বচ্ছতা রয়েছে বলে মনে করা হয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো ওই চিঠিতে এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দুদক।
সারাবাংলা/ইএইচটি/এমও