৪০ বছরে গ্যাসের আগুনে পোড়া এত রোগী দেখিনি: সামন্ত লাল
৯ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:৪১
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ‘গত সোমবার বিকেল চারটার দিকে চা বানাতে যাই, চুলা জ্বলে না। ছেলে এসে দাঁড়াইলো পাশে, চাবি ( গ্যাস জ্বালানো) দিল। আগুন লাইগা গেল, আর কিছু জানি না’ বলছিলেন পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জের বাসিন্দা শাহানা বেগম (৭০)।
শাহানার ডান হাত-পাসহ শরীরের অনেকখানি অংশ পুড়ে গেছে, তবে তিনি বিপদমুক্ত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের ফিমেল ওয়ার্ডের বিছানায় শুয়ে বলছিলেন শাহানা বেগম।
জানালেন, কয়েক বছর বিদেশ থাকার পর ছেলে নজরুল ইসলাম (৪০) দেশে ফিরেছেন। সেদিন ছেলেটা আমারে বাঁচাইতে গিয়ে পুইড়্যা গেল, এখন আমি জানি না আমার ছেলের কী অবস্থা, বলে কাঁদেন শাহানা বেগম।
আরও পড়ুন: ‘গ্যাসের আগুন আমার সব শেষ করে দিল’
শাহানার মেয়ে নাসিমা বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে তার ভাইয়ের অবস্থা সংকটাপন্ন। বেঁচে থাকবে কি না! সে কথা বলেই চোখের কোন মোছেন তিনি।
চিকিৎসকরা জানান, নজরুল ইসলামের অবস্থা গুরুতর, তিনি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন।
শাহানার সঙ্গে কথা শেষ করে আসার সময় চোখে পড়ে বার্নের বারান্দাতে মলম লাগানো দুই হাতে উঁচু করে দেয়ালের সঙ্গে আধশোয়া হয়ে আছেন এক যুবক। গত ৩৫ দিন ধরে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন আতাউর রহমান। সাভারের হেমায়েতপুর নাসরিন অটো মোবাইল নামের একটি দোকানে কাজ করেন আতাউর।
তিনি জানান, সেদিন সন্ধ্যা ছয়টার দিকে রান্না করতে গেলে তিনি এবং তার রুমমেট আমিনুর দগ্ধ হন। তিনি বলেন, গ্যাসের চুলার লাইনে সমস্যা ছিল, ম্যাচ জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে আগুন লেগে যায়। তারপর আর কিছু মনে নেই তার।
প্রথমে স্থানীয় এক হাসপাতালে নেওয়ার পর তারা ঢামেক বার্নে স্থানান্তর করলে দুজনকেই প্রথমে আইসিইউতে রাখা হয়। কিন্তু ১০ দিন আইসিইউতে থাকার পর মারা যান আমিনুর। আর সাতদিন আইসিইউতে থাকার পর আতাউরকে স্থানান্তর করা হয় সাধারণ ওয়ার্ডে।
আতাউরের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন বিছানায় বসে আতাউরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এক বৃদ্ধ। আতাউর কী হয় জানতে চাইলে তিনি জানান, তার ছেলে।
নীলফামারী থেকে মোহাম্মাদ আক্তার পরদিনই এসেছেন ছেলের এমন খবর পেয়ে। গ্রামের বাড়িতে কৃষিকাজ করে সংসার চালান। দুই ছেলের মধ্যে আতাউর ছোট। তবে এ পর্যন্ত আতাউরের চিকিৎসার সব খরচ তার কোম্পানি থেকে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে মোহাম্মদ আক্তার বলেন, ‘ছোল (ছেলে) থুয়ে (রেখে) যাইতে পারিচ্চি না, ওষুধ আনতি হয়, এটা-সেটা লাগে।’
সিলিন্ডার বিস্ফোরণ এবং পাইপ থেকে বিস্ফোরণ হয়ে দগ্ধ হওয়া রোগীদের বিষয়ে জানতে চাইলে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন সারাবাংলাকে বলেন, আমার ৪০ বছরের চিকিৎসক জীবনে গ্যাসের আগুনে পুড়ে যাওয়া এত রোগী দেখিনি। গত কয়েকমাস ধরেই এসব দেখে দেখে শঙ্কিত। কিন্তু এত গ্যাসের লাইনের কারণে, ইলেক্ট্রিক বার্ন, ফ্লেম বার্ন-এসব দেখিনি।’
গত একমাসে গ্যাসের কারণে পুড়ে যত রোগী এসেছে সেটা এই ইউনিটেও আর কখনও হয়নি বলেন মন্তব্য তার।
তিনি বলেন, আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, এগুলোর বিরুদ্ধে এখন একটা ক্রাস প্রোগ্রামে যাওয়া উচিত। যেখনে সরকার, তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ, বাড়িওয়ালা, রাজনৈতিক, চিকিৎসক, গণমাধ্যম কর্মী-প্রত্যেকের সোচ্চার হওয়া উচিত। খুঁজে বের করা উচিত কেন এ সব দুর্ঘটনা ঘটছে।
এবং গ্যাসের লাইন কেন লিকেজ হবে-এ ঘটনা যদি খুঁজে বের না করা যায়, তাহলে এই মৃত্যুর মিছিল ক্রমেই দীর্ঘ হবে, বলেন তিনি।
ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘চিকিৎসার পাশাপাশি সচেতনা এবং প্রতিরোধের ওপর জোর দিতে হবে, কীভাবে বন্ধ করা যায়-সেখানে জোর দিতে হবে, এর অংশ হিসেবে পাড়ায়-মহল্লায় মসজিদে প্রচারণা চালানো হতে, টেলিভিশনে দেখানো হয়, বিজ্ঞাপন দেখানো হয়-তাহলে হয়তো সচেতনতা তৈরি হবে। সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই। আর এ জন্য ভাড়াটিয়া এবং যিনি ভাড়া দিয়েছেন দুজনেরই দায়িত্ব এ সর্ম্পকে দায়িত্ববান হওয়া। গ্যাসের লাইন ঠিক আছে কীনা, পাইপ লিকেজ হচ্ছে-সেটা মেরামত করা, অবৈধ কানেকশন রয়েছে কীনা-এ বিষয়ে কঠোর হওয়া উচিৎ।’
‘অনেক সময় শুনি গ্যাসের লাইনের অবৈধ পাইপ ছিল-এগুলোকে সরকার যদি কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ না করে তাহলে এ বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে না এবং মিডিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে জানিয়ে ডা. সেন বলেন, একইসঙ্গে স্বাস্থ্যকর্মীরা যদি বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুঝিয়ে বলে তাহলে মানুষ নিশ্চয় বুঝবে। কারন, বিভিন্ন ইস্যুতে দেখেছি-সাধারণ মানুষ সচেতন হয়েছে আগের চেয়ে। সেসব বিষয়ে যদি সচেতনতা আনা যায় তাহলে এ বিষয়ে কেন করা যাবে না। প্রচার প্রচারণা বাড়ানো দরকার। আমরা ৫০০ শয্যার হাসপাতাল উদ্বোধন করেছি, কিন্তু সচেতন না হলে আরও শয্যা বাড়িয়েও লাভ হবে না’-বলেন ডা. সামন্ত লাল সেন।
বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জুনিয়র কনসালটেন্ট ডা. শারমিন সুমি বলেন, ‘ভয়ঙ্করভাবে পুড়ে যাওয়া এমন রোগীও পাই, যার সিভিলাইন করা যাচ্ছে না, শক্ত হয়ে আছে শরীর।’
ডা. শারমিন সুমি বলেন, ‘গ্যাসের লাইন চেক করা হয় না বছরের পর বছর-এমনটাই মনে হয় আমার।
এ সময় ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘তিতাস গ্যাস থেকে প্রতিটি বাসায় যাওয়া অত্যন্ত জরুরি। তাদের একটা কার্ড থাকবে, সেই কার্ড নিয়ে প্রতিটি বাড়িতে যাবে, সব কিছু চেক করে কার্ড দেবে-এমন একটা সিস্টেম যদি করা যায়-তাহলে হয়তো এ দুর্ঘটনা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।’
সারাবাংলা/জেএ/একে