‘একঘরে’ লতিফ নির্বাচনের আগমুহূর্তে কঠিন চ্যালেঞ্জে
১০ নভেম্বর ২০১৮ ১১:০০
।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: বন্দরনগরীর ভিআইপি আসন হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম-১১ অর্থাৎ বন্দর আসন। গত দুই দফায় এই আসনে সংসদ সদস্য হিসেবে আছেন আওয়ামী লীগের এম এ লতিফ। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের পোড়খাওয়া নেতা খোরশেদ আলম সুজনকে দেওয়া মনোনয়ন পাল্টে লতিফকে দেওয়া হয় নৌকার টিকেট। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও লতিফকেই প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ।
তবে এবারের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করেও ব্যবসায়ী কোটায় দলের মনোনয়ন বাগিয়ে দু’বার সংসদ সদস্য হওয়া লতিফের পাশ থেকে সরে গেছেন অধিকাংশ নেতাকর্মী। চট্টগ্রামের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের সঙ্গেও তৈরি হয়েছে তার দূরত্ব। আর এলাকায় নিয়মিত সভা-সমাবেশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে লতিফ প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সুজন। নির্বাচনের আগমুহূর্তে এসে জোরালো আওয়াজ উঠেছে, লতিফ হটাও।
নগর আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, বন্দর আসন থেকে লতিফের বিপরীতে আওয়ামী লীগ থেকে যারা মনোনয়ন চাইবেন, তাদের সবাই মনোনয়ন বোর্ডের কাছে অভিন্ন সুরে বক্তব্য রাখবেন। এ বিষয়ে মেয়রের মধ্যস্থতায় এরইমধ্যে একমত হয়েছেন সম্ভাব্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা।
সবার দাবি থাকবে- ছাত্রলীগ, যুবলীগ করে আসা অর্থাৎ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তৃণমূল থেকে যারা জড়িত তাদের মনোনয়ন দিতে হবে। লতিফ বাদে অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীরা সবাই তৃণমূল থেকে রাজনীতি করে আসা যে নেতাকেই প্রার্থী করা হবে, তাকেই সম্মিলিতভাবে মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেবেন।
এ প্রক্রিয়ায় দলের শীর্ষপর্যায়ের কাছে এম এ লতিফের ‘একঘরে’ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হবে বলে সিদ্ধান্ত চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের।
সূত্র মতে, গত মঙ্গলবার (০৬ নভেম্বর) মধ্যরাতে চট্টগ্রামে প্রেসক্লাব ভবনে মেয়র হজ কাফেলার কার্যালয়ে বন্দর আসনের দুজন মনোনয়ন প্রত্যাশীকে নিয়ে বৈঠক করেন। এরা হলেন- নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু। সেই বৈঠকে দুই মনোনয়ন প্রত্যাশীকে ‘এক’ করে দেন মেয়র। দুজনই অভিন্ন সুরে মনোনয়ন বোর্ডের কাছে বক্তব্য রাখার বিষয়ে একমত হন।
এই দুজনের বাইরে সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম বাহাদুর এবং নগর আওয়ামী লীগের সদস্য মো. ইলিয়াসও দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তবে সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আছেন খোরশেদ আলম সুজন। আর ব্যবসায়ী নেতা হিসেবে আলতাফ হোসেন বাচ্চুর গ্রহণযোগ্যতাও আছে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে।
জানতে চাইলে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘তৃণমূল থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করে নেতৃত্বের পর্যায়ে যাওয়া একজন নেতাকে মনোনয়ন দেওয়াটা তো অমূলক কোন প্রত্যাশা নয়। এটা তো আমরা চাইতেই পারি যে, যিনি দলের দুঃসময়ে রাজনীতি করেছেন তিনিই যেন মনোনয়ন পান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যারা রাজনীতি করেছেন, পঁচাত্তর পরবর্তী দুঃসময়ে যারা দলকে ধরে রেখেছিলেন, দুঃসময় পার করা ত্যাগী নেতাদের পরিবর্তে যদি উড়ে এসে কেউ জুড়ে বসে, তাহলে তৃণমূলের কর্মীদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।’
মেয়র হজ কাফেলার কার্যালয়ে বৈঠকের কথা স্বীকার করেছেন খোরশেদ আলম ও আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু।
সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘তৃণমূলের পছন্দের একজন, যিনি ছাত্রলীগ-যুবলীগ করে এসেছেন, মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় এমন কাউকে প্রার্থী যেন করা হয় সেই বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। কোনোদিন রাজনীতি করেননি, আওয়ামী লীগের আদর্শের বিপরীতে থাকেন, জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে অতীতে কিংবা বর্তমানে সংশ্লিষ্ট এমন কাউকে প্রার্থী না করার বিষয়ে আমাদের দাবি থাকবে।’
‘১৯৭০ সাল থেকে আমি রাজনীতিতে আছি। প্রত্যেক রাজনৈতিক কর্মীর স্বপ্ন থাকে সংসদে গিয়ে মানুষের কথা বলার। আমি এখন জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি। দলের পরীক্ষায় আমি বারবার উত্তীর্ণ হয়েছি। আমার রাজনৈতিক এবং সামাজিক কমিটমেন্ট আছে। আশা করি দল এবার আমাকে মূল্যায়ন করবে’ বলেন সুজন
আলতাফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যারা তৃণমূল থেকে ছাত্রলীগ-যুবলীগ করে এখন আওয়ামী লীগ করছি, আমরা মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে অভিন্ন বক্তব্য রাখব। হঠাৎ করে দলে এসে মনোনয়ন নিয়ে এমপি হয়ে যাওয়া, এটা তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পছন্দ করেন না। এবার আমরা এই ধরনের কাউকে মনোনয়ন না দেওয়ার অনুরোধ করব।’
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি এম এ লতিফ ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য হয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেন। সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃত করে ফেস্টুন ছাপিয়ে। সেসময় বর্ষীয়ান রাজনীতিক প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীও লতিফের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিলেন। জোরালো আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন খোরশেদ আলম সুজন।
তখন এম এ লতিফের পাশে ছিলেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। একবছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দরে আধিপত্য নিয়ে মেয়রের সঙ্গেও বিরোধে জড়ান লতিফ, এমন আলোচনা আছে গণমাধ্যমে।
মূলত এরপর মেয়র ও তার অনুসারীরা লতিফের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। এর মধ্যে গত মার্চে লতিফ প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর বাসায় গিয়েও আলোচনার জন্ম দেন। মহিউদ্দিন জীবিত থাকতে লতিফ ঢুকতে পারেননি তার বাসায়। ‘জামায়াত সংশ্লিষ্টতার’ অভিযোগে মহিউদ্দিন লতিফকে কাছে ঘেঁষতে দিতেন না।
মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর তার অনুসারীদের কাছে ভিড়তে চেয়েও পারেননি। নিজের আসনে আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী এতদিন পাশে ছিলেন, তাদের অনেকেই এখন আর লতিফের পাশে দেখা যায় না।
নির্বাচনের আগে এই কোণঠাসা অবস্থা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এম এ লতিফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা আমাকে পছন্দ করছেন না। কিন্তু জনগণ আমাকে পছন্দ করেন। তাহলে কোণঠাসা কেন হব ? রাস্তায় মিছিল, সভা-সমাবেশ করার চেয়ে মানুষের কাছে যাওয়াকে আমি বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি এবং আমি গত ১০ বছর ধরে সেটাই করেছি। যারা আমার বিরোধিতা করেন, তারা মিছিল-মিটিং করেন। জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’
তিনি বলেন, ‘যারা আমাদের পছন্দ করেন না, তারা আমার সমালোচনা করছেন। আমাকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করছেন। আমি তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে কখনো ভাবি না, জবাব দেয়ারও চেষ্টা করি না। তবে মানুষকে বোকা ভাবা ভুল। তারা অনেক বেশি সচেতন।’
সারাবাংলা/আরডি/একে