আটলান্টিক সিটি : তাঁর প্রিয় শহর
১৩ নভেম্বর ২০১৮ ১১:৩৪
মাজহারুল ইসলাম ।।
আটলান্টিক সিটি হুমায়ূন আহমেদের খুবই পছন্দের একটি জায়গা। মূলত দুই কারণে এই সিটি তাঁর পছন্দ। আটলান্টিক সাগরের পাড় ঘেঁষে পর্যটকদের হাঁটাহাঁটির জন্য তিন-চার কিলোমিটার বোর্ড ওয়াক। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে বসার জন্য লম্বা লোহার চেয়ারের ব্যবস্থা। আর রাস্তার দুই পাশে নানা ধরনের গিফট শপ ও বিভিন্ন দেশের খাবারের দোকান। এখানে সাগরের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা, গিফট শপ অথবা নাইন্টি নাইন সেন্টসের দোকান থেকে নিষাদ-নিনিতের জন্য একগাদা খেলনা কেনা তাঁর পছন্দের বিষয়। দ্বিতীয়ত ক্যাসিনোতে কিছু সময় কাটানো। ক্যাসিনো তাঁর পছন্দের জায়গা।
আমেরিকা বেড়াতে এলে একবার আটলান্টিক সিটি যাবেন না তা তো হয় না। তবে এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। সিঙ্গাপুরে রুটিন চেকআপ করতে গিয়ে চতুর্থ স্তরের ক্যানসার শনাক্তের পর চিকিৎসার জন্যে এবার তাঁর যুক্তরাষ্ট্রে আসা। ১৪ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে পৌঁছেছেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। ১৯ সেপ্টেম্বর নানান চেকআপ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর শুরু হলো তাঁর প্রথম কেমোথেরাপি। কাজেই বরাবরের মতো যুক্তরাষ্ট্রে এলেই আটলান্টিক সিটিতে ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা মাথায় এখনো ঠাঁই নিতে পারেনি।
সিঙ্গাপুর থেকে শহীদ হোসেন খোকন নিউইয়র্ক আসছেন ২৭ সেপ্টেম্বর শুধু হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে। থাকবেন দশ দিন। খোকন সিঙ্গাপুরে বসবাস করেন বহু বছর ধরে। পেশায় ব্যবসায়ী। সাহিত্যচর্চা করেন অনেক দিন ধরেই। একাধিক গল্প-উপন্যাসের বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। হুমায়ূন আহমেদের অন্ধভক্ত।
২০০২ সালে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর মা আয়েশা ফয়েজের বাইপাস সার্জারির সময় মূলত খোকনের সাথে হুমায়ূন আহমেদের পরিচয় ঘটে। আমার সাথে পরিচয় আরও খানিকটা আগে থেকে। আমি সেই চিকিৎসাপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তখন হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসার জন্য আমি তাদের সঙ্গে ১৪ দিন সিঙ্গাপুরে ছিলাম। আমাদের সহযোগিতা করার জন্য কয়েকদিন পর বন্ধু কমল এসে যোগ দেয়। খোকনের আন্তরিকতা সেসময় আমায় মুগ্ধ করে। এবার সিঙ্গাপুরে চেকআপের সময়ও খোকন সবসময় হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ছিলেন। খোকনের মাধ্যমেই প্রথম জানতে পারি হুমায়ূন আহমেদের কর্কট রোগ শনাক্তের খবর। নুহাশপল্লীর দুটি বড় স্কালপচার তিনি সিঙ্গাপুর থেকে এনেছিলেন হমায়ূন আহমেদের জন্মদিনের উপহার হিসেবে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত যে-কোনো মানুষ সিঙ্গাপুর গেলেই খোকন তাঁদের জন্য নিবেদিতপ্রাণ।
হুমায়ূন আহমেদ, শাওন ভাবি ও আমাকে ডেকে বললেন, খোকন আমেরিকা আসছে। এটা তাঁর প্রথম আমেরিকা আসা। এতদূর থেকে শুধু আমাকে দেখতে আসছে। আমি ওকে নিয়ে আটলান্টিক সিটি বেড়াতে যেতে চাই। তোমরা হোটেল বুক করো এবং কীভাবে যাব সে ব্যবস্থা করো।
হুমায়ূন আহমেদের শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় শাওন ভাবি প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছার কারণে ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেলেন হোটেল বুক করতে।
২৭ সেপ্টেম্বর খোকন এসে পৌঁছালেন জ্যামাইকার বাসায়। আমি সোহেলকে নিয়ে এয়ারপোর্ট গিয়েছিলাম তাকে আনতে। সোহেল আমার খালাত ভাই। ডিভি ওয়ান পেয়ে আমেরিকাতে আসে এবং এখানে পড়াশোনা শেষ করে সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ভালো চাকরি করে। নিউইয়র্কে আসার পর থেকে নানাভাবে সোহেল আমাদের সহযোগিতা করে আসছে। সোহেলও হুমায়ূন আহমেদের অসম্ভব ভক্ত।
হুমায়ূন আহমেদ খুবই খুশি হলেন খোকনকে দেখে। খোকন যখন জানতে পারল হুমায়ূন আহমেদ আটলান্টিক সিটি যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তখন সে চমকে উঠল। স্যারের এরকম শারীরিক অবস্থায় তিনি বেড়াতে যাবেন ? তাও আবার তাঁকে উদ্দেশ্য করে এই ভ্রমণ। খোকন ভেবেছিল প্রথম কেমো নেওয়ার পর হুমায়ূন আহমেদকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখবে। কিন্তু ঘটনা সে রকম নয়। ডাক্তারও বলেছেন স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে। হাসি-খুশি আনন্দে থাকতে। এ ছাড়া প্রথম কেমোর পর বিশেষ কোনো শারীরিক সমস্যা দেখা দেয় না। কারও কারও খাবারে অরুচি অথবা বমি হয়। হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে তার কোনোটাই ঘটেনি। সব জানার পর খোকন যথেষ্ট খুশি হলো এবং দুশ্চিন্তামুক্ত হলো এই ভেবে যে, স্যারের শরীর খুব বেশি খারাপ না। কেমো তাকে মোটেও দুর্বল করতে পারে নি। মানসিকভাবেও তিনি বেশ ভালো আছেন।
২৮ সেপ্টেম্বর দুপুর একটায় আমরা বাসা থেকে বের হলাম দুটো গাড়িতে। লোকসংখ্যা বেশি। হুমায়ূন আহমেদ, শাওন ভাবি, নিষাদ, নিনিত, ভাবির মা তহুরা আলী, খোকন ও আমি। দুপুর দু’টায় আমাদের বাস। ম্যানহাটন থেকে বাসগুলো ছাড়ে। চ্যানেল আইয়ের (বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি) আশরাফুল আলম খোকন ও আমার স্ত্রী স্বর্ণার ফুফাত ভাই সাব্বির আমাদের গ্রে-হর্ন বাসে তুলে দিতে রওনা হয়েছে। রাস্তায় প্রচণ্ড ট্রাফিক জ্যাম। আমরা বাস টার্মিনালে পৌঁছালাম ঠিক ২.০৫ মিনিটে। দৌড়ে গেলাম ডিপারচার গেটে। ততক্ষণে বাসের দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এতগুলো টিকিট বুঝি নষ্ট হয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানলাম প্রতি ঘণ্টায় একটি করে বাস আটলান্টিক সিটির উদ্দেশে রওনা হয়। যে-কোনো বাসে উঠে বসলেই হলো। শুধু যে তারিখের জন্য টিকিট ইস্যু করা ওই তারিখের মধ্যে ভ্রমণ করতে হবে। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করে আমরা পরের বাসে আটলান্টিক সিটি রওনা হলাম।
আটলান্টিক সিটিতে আমাদের দুই রাত থাকার কথা। ইন্টারনেটে শো-বোর্ট নামে একটা হোটেল বুক করা হয়েছে। হোটেলের পেছন দিয়ে একটু হাঁটলেই বোর্ড ওয়াক অর্থাৎ আটলান্টিক সাগর পাড়ের হাঁটার রাস্তা। মাত্র তিন মাস আগে হুমায়ূন আহমেদ এখানে এসেছিলেন বেড়াতে। সঙ্গে স্ত্রী ও দুই শিশুপুত্র। এই হোটেলেই দু’রাত কাটিয়েছেন তাঁরা। সে সময় তাঁরা এক মাসের জন্য আমেরিকা এসেছিলেন। ভিসা জটিলতার কারণে আমি তখন সঙ্গে আসতে পারিনি। হোটেলটা হুমায়ূন আহমেদ খুব পছন্দ করেছিলেন। সে কারণে এই হোটেলেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। হোটেল থেকে বেরোলেই বাচ্চাদের প্লে-জোন।
শো-বোর্টে তিনটা রুম ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এক রুমে হুমায়ূন আহমেদ সপরিবারে। দ্বিতীয় রুমে শাশুড়ি তহুরা আলী একা। তৃতীয় রুমে আমি ও সিঙ্গাপুর থেকে আগত আমাদের বন্ধু খোকন।
আটলান্টিক সিটি যাওয়ার পথে মনে হলো হুমায়ূন আহমেদ তো একনাগাড়ে দুই রাত তিন দিন ভাত না খেয়ে থাকতে পারবেন না। তা ছাড়া এই মুহূর্তে তাঁর বাইরের খাবার বেশি না-খাওয়াই ভালো। মনে পড়ল নাসিম ভাইয়ের কথা। এর আগেরবার তাঁর বাড়িতে অনেক খাওয়া-দাওয়া হয়েছিল। ঢাকায় নাসিম ভাইয়ের বন্ধু খোকনকে ফোন করে তাঁর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করলাম। হুমায়ূন আহমেদের চার খোকনের আরেক খোকন। দীর্ঘদিন নিউইয়র্কে বসবাসের পর এখন ঢাকায় স্থায়ী হয়েছেন। ফোনে একবারেই নাসিম ভাইকে পেয়ে গেলাম।
হুমায়ূন আহমেদসহ আমরা তাঁর শহরে আসছি শুনে চিৎকার দিয়ে উঠলেন নাসিম ভাই। কেন তাঁকে আগে জানাইনি, আগে জানালে তিনি গাড়ি নিয়ে নিউইয়র্ক থেকে আমাদের নিয়ে আসতেন ইত্যাদি। কেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বাসে আসছি। আমি বললাম, পরবর্তী সময় আপনাকে জানাব আগে থেকে। দু-একবেলা আপনার বাসায় হুমায়ূন আহমেদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। নাসিম ভাই বললেন, দু-এক বেলা কেন ? প্রত্যেক বেলাই আমার বাসায় খাবেন। এটা তো আমার পরম সৌভাগ্য। আপনি এসব নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না। আমাকে আর কোনো কিছুই বলতে হলো না।
হোটেল শোবোটের সামনে বাস থেকে নামতেই দেখি নাসিম ভাই গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো। এরপর থেকে দুই রাত তিন দিন আমরা সবাই নাসিম ভাইয়ের মেহমান হয়ে গেলাম। সকালে নাসিম ভাই-ভাবি হুমায়ূন আহমেদের পছন্দের নাস্তা নিয়ে হোটেলে হাজির। সব রুম থেকে সবাইকে ডেকে ডেকে নাস্তা খাওয়ানো যেন একটা উৎসবে পরিণত হলো। কাজকর্ম বন্ধ করে নাসিম-দম্পতি হুমায়ূন আহমেদের সেবায় নিয়োজিত। রাতে তাদের বাড়িতে গিয়ে আমরা খেয়ে আসি। টেবিলভর্তি হুমায়ূন আহমেদের পছন্দের সব খাবার। পরদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত আমরা সবাই বোর্ড ওয়াকে সময় কাটালাম। বাচ্চাদের প্লে-জোন শীতের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বলে নিষাদের মন খারাপ। আমার কাছে মনে হলো নিষাদের চেয়ে হুমায়ূন আহমেদের মন আরও বেশি খারাপ হয়ে গেল। মন ভালো করার জন্য নাইন্টি নাইন সেন্টের দোকান থেকে এক ব্যাগ ভর্তি খেলনা কেনা হলো নিষাদের জন্য। এরপর হাঁটতে হাঁটতে একটা গাছের ভাস্কর্যের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন হুমায়ূন আহমেদ। একটা গিফটশপের সামনে ভাস্কর্যটি রাখা। বিভিন্ন উচ্চতায় গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে আছে তিন শিশু। এক শিশু দড়ি ঝুলিয়ে ঝুলছে তাতে। আরেক শিশু গাছে চড়ার চেষ্টা করছে। সহসাই যেন হুমায়ূন আহমেদ শৈশবে ফিরে গেলেন। এগিয়ে গেলেন ভাস্কর্যটির কাছে। চোখে রাজ্যের মুগ্ধতা। কিছুক্ষণ পর জানালেন এরকম একটি ভাস্কর্য কিনতে চান তিনি, দেশে তাঁর নুহাশপল্লীতে রাখতে চান। খোঁজ নিয়ে জানা গেল এর যা দাম পড়বে, দেশে নিয়ে যেতে খরচ হবে তার কয়েক গুণ।
এক রাতে নিষাদকে তার নানির রুমে রেখে কিছু সময়ের জন্য আমরা নিচে ক্যাসিনোতে গিয়েছিলাম। নানির সঙ্গে ইচ্ছামতো আনন্দ করেছে সাড়ে চার বছর বয়সী নিষাদ হুমায়ূন। পরদিন দুপুরে চেকআউট করার সময় ১২০ ইউএস ডলার জমা দিতে হলো কাউন্টারে। কারণ খেলতে গিয়ে নিষাদ পরপর দুইবার বড়দের পে-চ্যানেলে চাপ দেওয়ায় এই বিল দিতে হয়েছে। পে-চ্যানেল চালু করলেই পয়সা দিতে হবে। যতক্ষণই দেখা হোক না কেন একই ডলার পে করতে হবে।
দুপুরে আমরা বোর্ড ওয়াকে একটা চায়নিজ রেস্টুরেন্টে খেয়েছিলাম। বাদবাকি সব খাবারই ছিল নাসিম ভাই ও তাঁর স্ত্রীর আয়োজনে। আমার একজীবনে যে কয়জন ভালো মানুষ দেখেছি তাদের মধ্যে এই দম্পতি অন্যতম। অসাধারণ ভালো মানুষ তাঁরা।
আমেরিকায় প্রায় নয় মাসের চিকিৎসাকালে আরও একবার আটলান্টিক সিটি ঘুরতে গিয়েছিলাম আমরা। সেবার স্বর্ণা ও আমাদের দুই পুত্র অমিয়, অন্বয় সঙ্গে ছিল। মূলত ওদের জন্যই তখন আটলান্টিক সিটিতে যাওয়া। উদ্যোগটা ছিল হুমায়ূন আহমেদের। চারটা শিশু একসাথে থাকায় আনন্দ হইচই অনেক বেশি হয়েছিল। শিশুদের আনন্দে মুগ্ধ হুমায়ূন আহমেদ। শীতকাল হওয়ায় শিশুদের জন্য ইনডোর প্লে-জোন খুঁজে পাওয়া গেল বোর্ড ওয়াকে। চার শিশু প্লে-জোন থেকে কোনোভাবেই বের হবে না। হুমায়ূন আহমেদ তাদের সংস্পর্শে কিছু সময়ের জন্য যেন শিশু হয়ে গেলেন। নিজেও শিশুদের সঙ্গে নানা খেলায় অংশ নিলেন।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ২০০১-এ প্রথম আমেরিকা ভ্রমণে দু’দফা আটলান্টিক সিটিতে এসেছিলাম। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণে ক্লান্ত হয়ে নিউইয়র্ক পৌঁছলাম দুপুর তিনটায়। হোটেলে চেক-ইন করলাম বিকেল পাঁচটায়। সন্ধ্যায় হুমায়ূন আহমেদ বললেন, আমি আটলান্টিক সিটি যেতে চাই। সেই প্রথম আটলান্টিক সিটি যাওয়া। ক্যাসিনো ‘তাজ’-এর সামনে আমাদের গাড়ি থামল। রাত তখন দশটা। চোখ ধাঁধানো আলো ঝলমলে রাতের শহর মুগ্ধ হয়ে দেখছি। লিমোজিনে করে ধনকুবেররা এসে নামছে। আমরা ক্যাসিনো তাজ-এ প্রবেশ করলাম। প্রথম রাতেই বাজিমাত। কয়েন দিয়ে স্লেটে মেশিনে খেলছি। হঠাৎ মেশিনের উপরে লাল রঙের বাতি জ্বলে উঠলো এবং বিকট শব্দে সাইরেন বাজছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে কোনো ভুল করে ফেলেছি কি না। ভুল বাটনে চাপ দিয়েছি কি না। এরমধ্যে হুমায়ূন আহমেদ ও তার বন্ধু ফজলুল করিম দৌড়ে এসে বললেন, তুমি জ্যাকপট পেয়েছ। অভিনন্দন। ক্যাসিনোর দু’জন কর্মচারী এসে চাবি দিয়ে সাইরেন বন্ধ করল এবং আমাকে মেশিন থেকে একটা প্রিন্টেড কুপন বের করে দিয়ে বলল ক্যাশ কাউন্টারে যেয়ে ভাঙিয়ে আনো। নয় শ’ ডলারের কুপন। আমি নয় শ’ ডলার জিতেছি। আমার এই প্রথম ক্যাসিনো অভিজ্ঞতা। আমার চেয়ে অনেক বেশি খুশি হলেন হুমায়ূন আহমেদ। পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ এবং অবিশ্বাস্য। পনের মিনিট পর একই মেশিনে আবারও সাইরেন বেজে উঠল। এবার আমি চিৎকার করে উঠলাম। জ্যাকপট পেয়েছি, জ্যাকপট পেয়েছি। আবার হুমায়ূন আহমেদ, ফজলুল করিম ও কমল দৌড়ে এল। এবারো নয় শ’ ডলার। আমি মুগ্ধ, বিস্মিত।
দুই দিন পর আমরা ওয়াশিংটন ডিসির উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার পথে হুমায়ূন আহমেদকে নিউজার্সিতে তার বড় মেয়ে নোভার বাসায় নামিয়ে দিয়ে যাব। নোভা সেসময় ঢাকায়। নোভার বর আরশাদের সঙ্গে দুই দিন এখানে থাকবেন তিনি। ওয়াশিংটন থেকে ফেরার পথে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নিউইয়র্ক ফিরে আসব। এমন পরিকল্পনা হুমায়ূন আহমেদের।
তিনি বললেন, তুমি এবং কমল প্রথম আমেরিকা এসেছো। কাজেই হোয়াইট হাউজ না দেখে গেলে কি হয়! সারা দুনিয়ার রাজার বাড়ি বলে কথা। আর ওয়াশিংটন যেহেতু যাবেই, তাই সেখান থেকে কিছুটা দূরে ল্যুরে ক্যাভার্নে যাবে। সেখানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ক্রিস্টাল কেভ।
সে অনুযায়ী আমরা নোভার বাসায় হুমায়ূন আহমদকে নামিয়ে দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির পথে রওনা হলাম। গাড়ি চালাচ্ছেন আবেদিন ভাই। পাশের সিটে বসা তার স্ত্রী জলি আপা। ফজলুল করিম ও ইমদাদুল হক মিলন মাঝের সিটে। আমি ও কমল বসেছি পেছনের সিটে। মাঝে মাঝে হুমায়ূন আহমেদ টেলিফোনে আমাদের খোঁজখবর নিচ্ছেন। একবার বললেন, ল্যুরে ক্যাভার্ন না দেখে কিন্তু আসবে না। ল্যুরে ক্যাভার্ন ওয়াশিংটন থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরে।
পড়ন্ত বিকেলে আমরা ওয়াশিংটন পৌঁছলাম। সরাসরি হোয়াইট হাউজের সামনে চলে গেলাম। খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ নাই। দূর থেকে যতটা সম্ভব দেখে গাড়িতে উঠেছি। গন্তব্য আমার সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক সুব্রত শংকর ধরের বাড়ি। তিনি বিশ্বব্যাংকে বড় কর্তা। ভার্জিনিয়ার সেন্টার ভিলে তার বিশাল বাড়ি। ওয়াশিংটন আসছি শুনে স্যার খুব খুশি। স্যার তার বাড়িতে থাকতে বলেছেন। এরমধ্যে হুমায়ূন আহমেদের ফোন। করিম ভাইকে বলছেন, হোয়াইট হাউজ দেখা হয়ে গেছে কাজেই এখন তোমরা ফিরে আসো। আর দেখার কিছু নাই। আমরা ভাবছি হুমায়ূন আহমেদ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে হয়তো রসিকতা করছেন। একটু পর আমাকে ফোন করলেন। একই কথা ফিরে আসো। আমার এখানে একা ভালো লাগছে না। আমি বললাম, আপনি না বললেন ল্যুরে ক্যাভার্ন দেখে আসতে! তিনি বললেন, ল্যুরে ক্যাভার্ন পরের বার দেখবে। তোমরা ফিরে আসো।
আমরা যখন সুব্রত স্যারের বাসায় পৌঁছলাম রাত তখন প্রায় ন’টা। এরমধ্যে আরও কয়েকবার হুমায়ূন আহমেদের ফোন। একই কথা—তোমরা এখনই ফিরে আসো। সুব্রত স্যার টেলিফোনে পিৎজা অর্ডার দিয়েছেন। কে কোন রুমে থাকব বৌদি ঠিক করছেন। কাল সকালে স্যার এবং বৌদি’ও আমাদের সঙ্গে কেভ দেখতে যাবেন। এরমধ্যে হুমায়ূন আহমেদের ফোন। করিম ভাইকে বলছেন, এখনো রওনা দাওনি তোমরা ? দুই বন্ধু তর্ক করছেন। করিম ভাই বলছেন, এত রাতে কীভাবে আসব? সবাই ক্লান্ত। এরপর আমাকে হুমায়ূন আহমেদ বললেন, তোমরা যদি এখন রওনা না দাও তাহলে আমি কালই ঢাকা ফিরে যাব। একপর্যায়ে আমরা ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। স্যার এবং বৌদি খুব মন খারাপ করলেন।
রাত এগারোটায় আমরা নিউজার্সির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলাম। হুমায়ূন আহমেদ মহা খুশি। কিছুক্ষণ পর পর ফোন করে আমাদের অবস্থান জানতে চাচ্ছেন। ভোর চারটায় আমরা আরশাদের নিউজার্সির বাড়ির সামনে পৌঁছে অবাক। হুমায়ূন আহমেদ বাড়ির সামনে পায়চারি করছেন। আমাদের দেখে গাড়িতে উঠে বললেন, চলো আটলান্টিক সিটি যাব। করিম ভাই খুবই রেগে গেলেন। গাড়ি থেকে নেমে বললেন, আমি তোমার পাগলামির মধ্যে নাই। আমি ঘুমাব। তোমার যেখানে খুশি যাও।
রাস্তায় ট্রাফিক না থাকায় এক ঘণ্টা বিশ মিনিটে আটলান্টিক সিটি পৌঁছে গেলাম। ভোরের আলো গায়ে মেখে আমরা ক্যাসিনো গ্রান্ড তাজ-এ পৌঁছলাম। সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত জমজমাট ক্যাসিনো ভোরের দিকে কিছুটা নিস্তেজ হয়ে আসে। মানুষের সংখ্যা যেমন কমে যায় তেমনি হেরে যাওয়া মানুষগুলো শুকনা মুখে ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে শেষ চেষ্টা করতে থাকে। ব্যাতিক্রম দুই-চারজন হয়তো হাসিমুখে বেরিয়ে যায়। আমাদের প্রিয় কবি নির্মলেন্দু গুণ গিয়েছিলেন এই আটলান্টিক সিটিতে জুয়া খেলতে। সারা রাত জুয়া খেলে সর্বশান্ত হয়ে নিউইয়র্কে ফেরার বাস ভাড়া না থাকায় ভিক্ষা করার কথাও ভাবছিলেন। না, তাঁকে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষা করতে হয়নি। তাঁর বন্ধু নিউজার্সি থেকে এসে তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা ‘ভ্রমণসমগ্র’ বইতে আটলান্টিক সিটিতে তাঁর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এই তথ্য পড়েছিলাম।
আমি আগের সেই মেশিন খুঁজে বের করে বসলাম আবারও জ্যাকপটের আশায়। হুমায়ূন আহমেদ দূরে একটা স্লোট মেশিনে বসে খেলছেন। মাঝে মাঝেই তার মেশিন থেকে বেরিয়ে আসা কয়েনের ঝনঝন শব্দ কানে আসছে। দুই ঘণ্টার মধ্যে আগের দিনের আঠারো শ’ ডলার শেষ করে খালি হাতে ক্যাসিনো থেকে বেরিয়ে এলাম। হুমায়ূন আহমেদের চেহারা দেখে মনে হলো, তাকেও দুই-চার শ’ ডলার দিয়ে আসতে হয়েছে। সারা দিনের জার্নি সেইসঙ্গে নিদ্রাহীন রাতের ক্লান্তি নিয়ে ম্যাগডোনালসে সকালের নাস্তা খেয়ে নিউজার্সির উদ্দেশে রওনা হলাম।
এরপর ২০০৫ সালে আরেকবার একসঙ্গে এসেছিলাম আমেরিকা। সেবারও আটলান্টিক সিটিতে দু’টি রাত খুব আনন্দে কেটেছিল আমাদের।
বন্ধু ও প্রিয়জনদের আনন্দ দিতে যে মানুষটি অসম্ভব পছন্দ করতেন, সব সময় যাঁর ভাবনা ছিল অন্যদের সঙ্গে কীভাবে আনন্দ শেয়ার করা যায়, তিনি আজ অদেখা ভুবনের বাসিন্দা। গল্প, উপন্যাস, নাটক, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আনন্দে ভাসিয়েছেন তিনি কোটি মানুষকে। আর কাছের মানুষদের দিয়েছেন দুর্লভ আনন্দদায়ক সঙ্গ। তাঁর প্রিয় জায়গা আটলান্টিক সিটির জৌলুস আর আকর্ষণ হয়তো আরও বাড়বে দিনে দিনে, কিন্তু আমরা যারা তাঁর সঙ্গী হয়ে এসেছি বারবার এই শহরে, তাদের কাছে কি সেই ঔজ্জ্বল্য আদৌ ধরা দিবে কখনো ?
মাজহারুল ইসলাম : প্রধান নির্বাহী, অন্যপ্রকাশ।
সারাবাংলা/পিএম