রিপার আর কেউ রইল না
১৩ নভেম্বর ২০১৮ ১২:৪০
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: গ্যাসের আগুনে দগ্ধ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আইসিইউতে ভর্তি দেড় বছরের আয়েশাকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে চিকিৎসকদের সব চেষ্টা। বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন সন্তানকে বাঁচাতে মা-রিপার সব আকুতি -আহাজারিকে হার মানিয়ে রোববার বিকেলে মারা যায় ছোট্ট আয়েশা।
সোমবার ( ১২ অক্টোবর) আয়েশাকে তার গ্রামের বাড়ি শেরপুরের ঝিনাইগাতি গ্রামে দাফন করা হয়। রিপার বড় বোন রেহানা বেগম সরাবাংলাকে জানান, আয়েশার মা রিপা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন।
রিপার বড় বোন রেহানা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, রোববার বিকাল ৫টার দিকে চিকিৎসকরা দেড় বছরের আয়েশাকে মৃত ঘোষণা করেন। তারপরই তারা নিয়ে শেরপুরের ঝিনাইগাতিতে চলে যান। সোমবার সকালে আয়েশাকে দাফন করা হয়। আর এরপর থেকেই মুর্ছা যাচ্ছেন রিপা। গ্যাসের আগুনের আহত রিপা মেয়েকে কবর দেওয়ার পর থেকেই প্রলাপ বকছেন আর জ্ঞান হারাচ্ছেন।
রেহানা জানান, গ্যাসের আগুনে পুড়ে একে একে শশুড়-শাশুড়ি,স্বামী সব শেষ। এরপর মাইয়্যাটারে বাঁচাইতে মরিয়া ছিল রিপা । এখন আর সেও নাই। নিজের বাপ-মা তো অনেক আগেই মইরা গেছে। ওরে স্বান্তনা দেওয়ার কোন ভাষা নাই।’
গত ৭ নভেম্বর ডান হাতে ব্যান্ডেজ আর মুখে মলম নিয়ে ২০ বছরের রিপা যখন মেয়ের জন্য কেঁদে কেঁদে আকুতি জানাচ্ছিলেন তখন আইসিইউর ভেতরে দেড় বছরের আয়েশার ড্রেসিং হচ্ছিলো। ড্রেসিং শেষে মেয়ের কাছে যাবার অনুমতি মেলে মায়ের, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে সব ধরণের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এ প্রতিবেদকেরও আইসিইউতে যাবার সুযোগ মেলে।
আইসিইউর ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ড্রেসিং শেষে ঘুমাচ্ছে আয়েশা, কেবল মুখটুকু ছাড়া পুরো শরীর সাদা লেপে ঢাকা। কর্কতব্যরত নার্স জানান, আয়েশার বা হাত আর কোমড় থেকে শরীরের নিচের পুরো অংশসহ আয়েশার ৩০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। আর রিপার পুড়ে গিয়েছে সাত শতাংশ।
রিপা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি তার বাবার একটা স্মৃতি রাখতে চাই। ওর বাবা যখন আগুনে পুড়ে যাচ্ছিলো, সে সময় তাকে আমি ধরতে যাই, কিন্তু তারে ধরতে না দিয়ে সে কেবল আমারে বলছিল, আমার বাবুরে বাঁচাও। সেই বাবুরেও যদি আমি বাঁচাইতে না পারি, তাইলে যে এই বংশের আর কেউ বাইচা থাকবো না।
আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল রিপার মেয়েকে বাঁচানোর জন্য আহ্বান ছিল আর্থিক সহযোগিতারও। রিপা বলছিলেন, আমাদের আর চলার মতো সাধ্য হইতেছে না, সব পুইড়ে ছাই হয়ে গেছে। কেবল নিজের জীবন আর মেয়েটার জীবন নিয়ে এখনও বেঁচে আছি। তিনটা জীবন শেষ-এখন কেবল, আপনাদের কাছে আর কিচ্ছু বলার নেই। আমি আমার স্বামীকে হারাইছি, কেবল আমার বাবুটারে বাঁচায়ে দেন, আমার কাছে আমার বাবুটারে ফিরায়ে দেন-আমার যে এই মেয়েটা ছাড়া আর কেউ নেই আপা। আমার আর কিচ্ছু লাগবে না, আমার মেয়েটারে আমার কাছে কেবল দেন।
আয়েশার অবস্থা ভালো ছিল না-চিকিৎসকরা সেকথাও জানিয়েছিলেন তাকে। রিপা বলেন, আমার বাবুর অবস্থা ভালো ছিল না, ডাক্তার কেবল বলছে, আল্লারে ডাকো। আমার বাবা নাই, আমার মেয়েটারও বাবা থাকবে না-এইটা কেমন লেখা লিখলো খোদা আমার কপালে।
এখন ও মেয়েটাও যদি না থাকে, আমিতো ওদের (স্বামী, শ্বশুড়, শাশুরি) কাউরে ধইরা রাখতে পারলাম না, মেয়েটারেও কী পারুম না-বলে রিপার আর্তচিৎকার ছুয়ে যায় সেখানে উপস্থিত সবাইকে।
জানা যায়, গত ২ নভেম্বর ঢাকার আশুলিয়ার জামগড়া মোল্লাবাজারের কবরস্থান রোডে অবস্থিত আব্দুল হামিদের বাসায় ঘটে এ দূর্ঘটনা।
রিপা জানান, গত তিন বছর ধরে তারা ওই বাসায় ভাড়া থাকতেন। এর আগেও একবার আগুন লেগে পুরো রান্নাঘর পুড়ে যায়। বাড়িওয়ালাকে বললে সে মেকানিক নিয়ে এসে গ্যাসের পাইপে গামটেপ (স্কচটেপ) লাগিয়ে দিয়ে যায়। বলে- আর কোনও সমস্যা নাই। কিন্তু মন মানছিল না, গত সপ্তাহেই আরেক বাসা দেখছিলাম, কিন্তু মাস শেষ না হওয়ায় যাইনি। আর তাতেই আমার ঘর-সংসার সব পুড়ে ছাই হয়ে গেল, বলতে থাকেন রিপা, দগ্ধ হন রিপার স্বামী আবদুর রব, শ্বশুর আরব আলী ও শাশুড়ি হাসিনা বেগম।
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা জানান, আবদুর রবের শরীরের ৩০ শতাং, আরব আলীর ৬০ শতাংশ ও হাসিনা বেগমের শরীরের ৯৬ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।
সারাবাংলা/জেএ/জেডএফ