Thursday 15 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চার বিষয়ে ফেল, ওরা অংশ নিচ্ছে এসএসসি পরীক্ষায়!


১৮ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:১৭ | আপডেট: ১৮ নভেম্বর ২০১৮ ১১:০৯

।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।

ঢাকা: গণিত ও ইংরেজিসহ চার বিষয়ে ফেল করার পরও ২০১৯ শিক্ষা বর্ষের মাধ্যমিক পরীক্ষায় (এসএসসি) অংশ নেওয়া সুযোগ মিলছে রাজধানীর তেজগাঁও মডেল হাইস্কুলে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকার পরও কেবল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির চাপের মুখে এমন অনিয়ম করতে বাধ্য হয়েছেন বলে দাবি করেছেন বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক।

একাধিক সূত্র বলছে, বেশ কবছর ধরে ম্যানেজিং কমিটির নামে একটি অসাধু চক্রের খপ্পরে পড়ে স্কুলটির শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। তবে গত দু’বছরে ম্যানেজিং কমিটির এমন উৎপাত বেড়েছে ভয়াবহ রকমের। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় যত প্রকার অনিয়ম করা যায় তার সবটুকুই তিনি করছেন।

যার সর্বশেষ প্রমাণ ইংরেজি, অংক, বিজ্ঞান ও আইসিটির মতো চার বিষয়ে ফেল করা শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ। সূত্র বলছে সর্বশেষ টেস্ট পরীক্ষায় এমন ১৪ শিক্ষার্থী একাধিক বিষয়ে ফেল করে। যাদের প্রত্যেকেই কমিটির সরাসরি হস্তক্ষেপে ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।

সারাবাংলার কাছে এমন একাধিক শিক্ষার্থীর আবেদনপত্র এসেছে। অকৃতকার্য হওয়া এসব শিক্ষার্থী রিটেস্ট কিংবা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি চেয়ে প্রধান শিক্ষক বরাবর যে আবেদনপত্র দিয়েছে তার সবগুলোতেই ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শামীম হাসানের জোরালো সুপারিশ রয়েছে। কোনো কোনোটিতে এসব শিক্ষার্থীর ফরম পূরণ করতে শ্রেণী শিক্ষককে নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।

শিক্ষাখাতে অনিয়ম দুর্নীতি রোধে চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি একটি আদেশ জারি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাতে বলা হয়, ‘আমাদের দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পূর্বে নির্বাচনী বা টেস্ট পরীক্ষা নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। উক্ত নির্বাচনী পরীক্ষায় সকল বিষয়ে উত্তীর্ণরাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে মর্মে বিধান বিদ্যমান। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে নির্বাচনী পরীক্ষায় এক/একাধিক বিষয়ে অনুত্তীর্ণদেরকেও নির্বাচনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে মর্মে মিথ্যা প্রত্যয়নপত্র প্রদানপূর্বক চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়ে থাকে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। এটা বন্ধ হওয়া সমীচীন।

বিজ্ঞাপন

এমতাবস্থায়, নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ ছাত্র/ছাত্রীরা যাতে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না পায় সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ও নির্বাচনী পরীক্ষার খাতাসমূহ পাবলিক পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে ও মাঝে মাঝে তাদের নমুনা পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ দুর্নীতি দমন কমিশনের স্মারক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

এদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৬ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এক বা একাধিক বিষয়ে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ না দিতে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের অধীন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ বরাবর একটি নির্দেশনা জারি করে।

ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের  পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক তপন কুমার সরকার স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়, ‘এসএসসি ও এইচএসসি নির্বাচনী পরীক্ষায় এক বা একাধিক বিষয়ে অনুত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মূল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অনুমতি না দেওয়া এবং নির্বাচনী পরীক্ষার উত্তরপত্র ৬ মাস সংরক্ষণ করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

তবে তেজগাঁও মডেল হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি শামীম হাসান এসব নির্দেশনার ধার ধারেন নি। ওইসব শিক্ষার্থী ‘অসুস্থতার কারণে অকৃতকার্য হয়েছে’ এমন কারণ দেখিয়ে তাদের রেজিস্ট্রেশন করাতে প্রধান শিক্ষককে বাধ্য করিয়েছেন তিনি।

বিদ্যালয়টির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কমিটির সভাপতির অন্তত দুজন অনুসারী রয়েছেন যারা এসব শিক্ষার্থীর অভিভাবকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

এর মধ্যে নাজিবুর রহমান নাজমুল নামের ম্যানেজিং কমিটির একজন সদস্য এ জন্য প্রধান শিক্ষককে দায়ী করেন। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি বলেন, যদি এমন ঘটনা ঘটে থাকে তবে তার সব দায়ভার প্রধান শিক্ষকের। এমন অনিয়মের দায় তার ওপর বর্তায় কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমিও প্রেসের লোক, আপনি স্কুলে একসময় আইসেন।’

কোন পত্রিকায় কাজ করেন জানতে চাইলে নাজমুল নিজেকে ‘আজকের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার’ বলে পরিচয় দেন। যদিও প্রায় একযুগ ধরে পত্রিকাটি বন্ধ রয়েছে।’

কমিটির অপর সদস্য হাবিবুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রধান শিক্ষক একক এখতিয়ারে এ কাজ করেছেন। আমরা বিভিন্নভাবে তাকে বাধা দিয়েছি কিন্তু তিনি তা শোনেননি।’

প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘তার বিরুদ্ধে দুদকেও অভিযোগ গেছে যার তদন্ত চলছে।’

নিজেকে দৈনিক সরেজমিন বার্তার সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার পরিচয় দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি এবং নাজমুল সাহেব (নাজিবুর রহমান নাজমুল) চেষ্টা করছি স্কুলটিকে ভালো করতে। ঢাকা শহরের মধ্যে সবচেয়ে কম টাকায় এখানে শিক্ষার্থীরা ফরম ফিলাপ করছে। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখেন।’

স্কুলের বেশ ক’জন অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্কুলটিতে মূলত দুইটি গ্রুপ রয়েছে। একটি ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির অনুসারী। অন্যটি প্রধান শিক্ষকের অনুসারী। তবে আর্থিক দিকটা কমিটির সভাপতি ও তার লোকজনই নিয়ন্ত্রণ করে। এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে বেশ দ্বন্দ্ব রয়েছে।

এ বিষয়ে তেজগাঁও মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হেলেনা খাতুন বলেন, ‘আমি দুদক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা দেখিয়েছি। আমরা একাধিকবার মিটিং করেছি। সভাপতিকে নিষেধ করে বলেছি এটা করা যাবে না। কিন্তু সভাপতি কোনো কথাই শোনেননি, উনি বলেছেন ফেল করা শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে।’

বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করেছেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অভিযোগ করলে টিকতেই পারব না। এখানে অনেক যন্ত্রণা। আমি খুব চাপের মুখে রয়েছি।’

এদিকে এসএসসির ফরম পূরণ নিয়ে এমন অভিযোগ রাজধানীর অনেক স্কুল থেকেই আসছে জানিয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসএসসির ফরম পূরণ বিষয়ে যে সব অভিযোগ আসছে সেসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। দুদকে অভিযোগ এলে আমরা ওইসব স্কুলে তাৎক্ষণিক অভিযান পরিচালনা করছি।’

তবে সুনির্দিষ্ট কোন স্কুল সম্পর্কে মন্তব্য করতে অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সত্য মিথ্যা প্রমাণ ছাড়া মন্তব্য করা যাবে না।’

এ বিষয়ে স্কুল কমিটির সভাপতি ও সিটি করপোরেশন তেজগাঁও-২৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শামীম হাসানের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেও তাকে মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়নি।

সারাবাংলা/এমএস/একে/জেডএফ

চার বিষয়ে ফেল তেজগাঁও মডেল হাইস্কুল