পরীক্ষা ছোটদের, দুশ্চিন্তায় বড়রা
১৮ নভেম্বর ২০১৮ ১৩:১৫
।।মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: রোববার (১৮ নভেম্বর) বেলা ১২ টা। রাজধানীর আফতাবনগর এলাকার একটি চায়ের দোকানে গণমাধ্যমকর্মী ফারুক খানের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেওয়া একমাত্র মেয়ের সিট পড়েছে রামপুরা একরামুন্নেছা হাইস্কুল কেন্দ্রে। মেয়েকে পরীক্ষায় বসিয়ে বনশ্রীর বাসায় কিংবা কর্মস্থলে গিয়ে আবার সময়মত ফিরতে পারবেন কি না এই আশঙ্কায় চায়ের দোকানেই সময় কাটাতে এসেছেন।
তিনি বলেন, সময়ের দুই ঘণ্টা আগে বাড়ি থেকে বের হয়েছি। পরীক্ষা ছোটোদের হলেও এ নিয়ে বড়দের টেনশনই বেশি। দুর্ভোগও কম হচ্ছে না। মোটামুটি একটা যুদ্ধে নামতে হয়েছে আমাদের। বাচ্চাদের জন্য এটা এক ধরনের মানসিক নির্যাতন।
কেবল ফারুক খানই নন, রোববার সকাল থেকে এমন অনেক অভিভাবকের সঙ্গেই কথা হয় এ প্রতিবেদকের। যারা তাদের সন্তানের পরীক্ষা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। পরীক্ষা কেমন হবে, রাস্তায় জ্যামে আটকে সময় নষ্ট হবে কি না কিংবা কেন্দ্রের পরিবেশ কেমন হবে এ নিয়ে প্রায় সব অভিভাবকের মধ্যেই শঙ্কা দেখা যায়।
রাজধানীর বাড্ডার সিরাজমিয়া স্কুল কেন্দ্রের সামনে সকাল ৯ টার দিকে দেখা যায় শিক্ষার্থীসহ কয়েক হাজার মানুষের সমাগম। বিদ্যালয়টির পাশের বিশাল মাঠ ছাপিয়ে মানুষের সে জটলা গিয়ে ঠেকেছে আশপাশের গলিগুলোয়। সকাল সাড়ে ১০ টায় পরীক্ষা শুরুর সময় নির্ধারণ করা থাকলেও প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী এসে উপস্থিত হয় সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যে। ফলে মাঠের ধুলোবালির সঙ্গে কোলাহল মিলে এক ধরণের উৎসবমূখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় সেখানে।
জীবনের প্রথম এতো বেশি ছাত্র-ছাত্রী দেখে শিক্ষার্থীদের অনেকেই ছিলো উচ্ছ্বসিত। যদিও বিপরীত চিত্র দেখা গেছে তাদের অভিভাবকদের মধ্যে। সেখানে কথা হয়, ভোলানাথ দাস নামের একজন অভিভাবকের সঙ্গে।
আরও পড়ুন: প্রাথমিক সমাপনী শুরু, পরীক্ষার্থী ৩১ লাখ
তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রায় একটি মাস এ পরীক্ষা নিয়ে টেনশন বয়ে বেড়াচ্ছি। বাসা থেকে কেন্দ্র বেশ দূরে হওয়ায় বাচ্চাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ছিল। তবে সবচেয়ে বেশি ভয় আমাদের। আমরা যারা অভিভাবক তারা বাচ্চাদেরকে একটা যুদ্ধে নামিয়ে দিয়েছি। অথচ এতোকিছু না হলেও হয়। এই বয়সে এতো বড় ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তার মতে, প্রাথমিক স্তরে স্কুল কেন্দ্রিক বার্ষিক পরীক্ষার নিয়মটিই ভালো ছিল। তাতেও লেখাপড়া খারাপ হয় না।
সরকার ঝরে পড়া কমাতে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে এ প্রশ্নে তিনি বলেন, দিন দিন লেখাপড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। তাই ঝরে পড়া এমনিতেই কমবে। এ জন্য কোনো পাবলিক পরীক্ষার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
কথা হয় নিউ নেশন আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, তার স্কুল থেকে এবার পিইসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে ২৫ শিক্ষার্থী। বছরের শুরু থেকেই এই ক্লাসের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার মধ্যেও প্রতিদিন তাদের জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি। তার মতে, প্রাথমিক স্তরে পাবলিক পরীক্ষা বেশ ক’বছর ধরে চলে আসলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রতিযোগিতা বেড়েছে। বিশেষ করে প্রাইভেট স্কুলগুলোর মধ্যে শিক্ষার্থী টানতে গিয়ে যে প্রতিযোগিতা তাতে বাড়তি চাপে পড়ছে এসব কোমলমতি শিক্ষার্থী।
সিরাজমিয়া স্কুল কেন্দ্রে মোট ৫০ টি স্কুলের ১১৮৯ শিক্ষার্থী এবারের পিইসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। এ পরীক্ষা আয়োজনে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে। এই স্কুলের দু’জন স্টাফ জানান, পরীক্ষার কারণে আগামী ২৬ তারিখ পর্যন্ত বিদ্যালয়ের অন্যান্য ক্লাস বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে অন্যরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া কমাতে ২০০৯ সালে পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা চালু করে সরকার। কিন্তু শুরু থেকেই কোমলমতি শিশুদের এই পাবলিক পরীক্ষা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। এমনকি বিভিন্ন মহলে এ পরীক্ষা নিয়ে তুমুল বিতর্কও উঠে। এসব বিতর্ক আমলে নিয়ে এ পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একাধিকবার ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে প্রাথমিক স্তর কোন শ্রেণি পর্যন্ত হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত না হওয়ায় এখনো এ পরীক্ষা উঠিয়ে দিতে পারেনি সরকার।
প্রসঙ্গত, সারাদেশে বর্তমানে ৬৫ হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এতে ৪ লাখ শিক্ষক ও ৫০ হাজার কর্মীর পাশাপাশি রয়েছে ১ কোটি ২০ লাখ শিক্ষার্থী। যারমধ্যে চলমান পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে প্রায় ২৭ লাখ পরীক্ষার্থী।
সারাবাংলা/এমএস/জেডএফ