‘কিছু বলার নয়, এখন চুপ করে থাকার সময়’
১৯ নভেম্বর ২০১৮ ১৭:২৬
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: জীবনের প্রাত্যহিক নিয়মে রাতে ঘুমিয়েছিলেন তিনি। সেই ঘুম ভাঙল টেলিফোনের আওয়াজে, তাঁর ভাষায় খুব কর্কশ শব্দে। সেই শব্দ এত তীব্র কর্ণভেদী ছিল, তার চেয়েও বেশি হৃদয়বিদারক ছিল টেলিফোনে বলা কথাগুলো ! এক রাতের মধ্যে মা-বাবা, ভাইবোনসহ পুরো পরিবার হারিয়ে এতিম হয়ে গিয়েছিলেন যে নারী, সেই নারীর জীবনে কি আর কখনো রাত শেষ হয়ে ভোর আসে?
‘আলসে খানার বাসিন্দা’ হিসেবে মায়ের কাছ থেকে আদরমাখা অপবাদ জুটেছিল, সেই আলসে খানা থেকে বের হয়ে তিনি হয়ে উঠলেন রাত শেষে ভোর আনার অদম্য সংগ্রামী। নিরন্তর সেই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনিই আবার হয়ে উঠলেন রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এই রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্রটিতে বোন শেখ রেহানাকে বলতে শোনা যায়, ‘বাংলাদেশের বাঙালিরা আমার বাবাকে মারবে, এটা তো ধারণারও বাইরে ছিল।’
চট্টগ্রামের প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে যে সিঁড়ির উপর বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়েছিল, সেখানে ফুল ছিটিয়ে দুই বোনের কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার দৃশ্য আবেগতাড়িত করে হলভর্তি দর্শকদের।
হাসিনা: অ্যা ডটার’স টেল- ৭০ মিনিটের তথ্যচিত্রটি দেখে একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন প্রতিক্রিয়া দেন শুধু এক লাইনে, ‘এটা কিছু বলার সময় নয়। চুপ করে থাকার সময়। স্তব্ধ হয়ে থাকার সময়।’
সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খানের আমন্ত্রণে সোমবার (১৯ নভেম্বর) বেলা ১১টায় চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিণে তথ্যচিত্রটি দেখলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনরা। ছিলেন নির্মাতা রেজাউর রহমান খান পিপলুও।
তথ্যচিত্রটি দেখে নির্মাণশৈলীর প্রশংসা করে নির্মাতা পিপলু খানকে অভিনন্দন জানান কবি ও সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘কোনো ধরনের প্রোপাগান্ডা নেই। একেবারে নির্মোহভাবে বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আমি মনে করি এটি একেবারে পূর্ণাঙ্গ প্রামাণ্যচিত্র। প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য এটা বানানো হয়নি।’
বিস্তার আর্ট কমপ্লেক্সের পরিচালক, সংস্কৃতিকর্মী আলম খোরশেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্মাণটা এমনভাবেই হয়েছে, যে-ই দেখবে তার হৃদয় স্পর্শ করবে। যাকে নিয়ে এই ফিল্ম, তাকে তো শুধু আমরা একজন প্রশাসক কিংবা রাজনীতিক হিসেবেই দেখি। কিন্তু তার উঠে আসার সংগ্রামটা তো চাপা পড়ে ছিল। সেদিক থেকে আমি মনে করি এটা আমাদের আত্মঅনুসন্ধানী একটা কাজও হয়েছে। আর এটার নাম ডটার’স টেল না হয়ে টু সিস্টার’র টেল হওয়া দরকার ছিল। কারণ শেখ রেহানার সংগ্রামও কম নয়। বাবার হত্যাকারীদের বিচারের ব্যাপারে তিনিও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। সবমিলিয়ে এটি একটি মহাকাব্যিক কাজ হয়েছে বলে মনে করি।’
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সভাপতি কলিম সরওয়ার বলেন, ‘১৯৮৩ সালে, আমি তখন ছাত্রলীগ করতাম, ঢাকায় একটি অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনাকে প্রথম দেখি। সেই অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনার মুখে কিছু কথা শুনেছিলাম। কিন্তু তার জীবনটা যে এত সংগ্রামমুখর, এতটা বেদনার সেটা খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক। সেইসময় আমরা কখনও কল্পনাও করতে পারিনি, এই সংগ্রামের চিত্র একদিন আমরা পর্দায় দেখব। কিংবা এই ইতিহাস মানুষ একদিন জানবে, সেটি কল্পনারও বাইরে ছিল। সেটা সম্ভব করেছেন একজন রাষ্ট্রনায়ক, তিনি শেখ হাসিনা।’
মা-বাবা, পুরো পরিবার হারিয়ে এত শোকের মধ্যে একজন নারী কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছেন, কিভাবে একটি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন, এটা সত্যিই বিস্ময়কর বলে মনে করেন চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ডেইজি মওদুদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিদেশে ছিলেন, মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেননি। কাউকে কিছু জানাতে পারেননি। এই দুঃসহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকা, এটা সত্যিই আবেগতাড়িত করেছে।’
পিপলু খান বলেছেন, ‘হাসিনা: অ্যা ডটার’র টেল’ একটি পূর্ণাঙ্গ ডকুড্রামা, যেটি নির্মাণে তার সময়ে লেগেছে পাঁচ বছর। গত ১৬ নভেম্বর মুক্তি পাওয়া এই তথ্যচিত্রটি গত চারদিন ধরে প্রদর্শনের পর দর্শকদের অনুভূতিতে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন তিনি।
‘দর্শকরা ডকুড্রামাটি দেখার জন্য ছুটে আসছেন। এটি দেখে তাদের কাছে মনে হচ্ছে না যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে একটি বানানো হয়েছে। এটি যে কোন মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্প হতে পারে। এখানে সেই মানুষটি হচ্ছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার সংগ্রামের গল্পটি তাদের বর্ণনার মধ্য দিয়ে আমরা তুলে ধরেছি। এখানে মানুষ যে আসছেন, গল্পের শক্তিতেই কিন্তু তারা আসছেন। এবং আমার বিশ্বাস গল্পের জোরে সবাই এটি দেখবেন।’ বলেন পিপলু খান।
মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সারের মেয়ে সংসদ সদস্য ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জীবন থেকে আসলে অনেককিছুই শেখার আছে। ইতিহাসের অনেককিছু জানা আছে। অনেক লড়াই-সংগ্রাম পেরিয়ে তিনি আজ বাংলাদেশের হাল ধরেছেন। যেখানেই ছবিটি মুক্তি পেয়েছে, সেখানেই দর্শকরা পিনপতন নীরবতায় ছবিটি দেখছেন। আবেগতাড়িত হচ্ছেন সবাই। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ইতিহাসের সত্য অনুসন্ধানে সকল দলমতের সবার উচিৎ ছবিটি দেখা।’
সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে এই ছবির মুক্তির কোন সম্পর্ক নেই জানিয়ে ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, ‘এটি শুধুই ছবি। এটিকে ছবি হিসেবেই দেখা উচিৎ।’
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আলী আব্বাস, কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার, কামরুল হাসান বাদল, জেষ্ঠ্য সাংবাদিক সমরেশ বৈদ্য, সৈয়দ আব্দুল ওয়াজেদ, দৈনিক বীর চট্টগ্রাম মঞ্চের সম্পাদক সৈয়দ উমর ফারুক, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ, যুগ্ম সম্পাদক চৌধুরী ফরিদ এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক মিন্টু চৌধুরীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ তথ্যচিত্রটি একসঙ্গে বসে দেখেছেন।
প্রতিদিন তিনবার করে তথ্যচিত্রটি প্রদর্শন হচ্ছে চট্টগ্রামের নাসিরাবাদে সিলভার স্ক্রিনে। যেখানে প্লাটিনাম আসনের দাম ২৫০ ও ৪০০ টাকায়। ভিআইপি আসনের দাম এক হাজার টাকা।
সারাবাংলা/আরডি/এসএমএন