জামায়াতে বিভক্তি, চট্টগ্রামে মুখোমুখি দুই নেতার অনুসারীরা
২১ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:২৯
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১১ বছর আগে চট্টগ্রামে জামায়াতে ইসলামীর দুই নেতার দ্বন্দ্ব সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। দুই নেতার অনুসারী কর্মীরা প্রকাশ্য দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত একটি নির্বাচনি আসন নিয়ে দুই নেতার বিরোধ এখন চট্টগ্রামের রাজনীতিতে অন্যতম আলোচনার বিষয়।
জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের মতে, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সামরিক সরকারের আমলে প্রকাশ্য রাজনীতি শুরুর পর বাংলাদেশের কোথাও জামায়াত ইসলামীর নেতাদের মধ্যে এত বিরোধ তৈরি হয়নি। কোথাও বিরোধ হলেও সেটা প্রকাশ্যে আসেনি। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামের দুই নেতার এই বিরোধ জামায়াতকে আরও সংকটে ফেলেছে।
জামায়াতে ইসলামীর আলোচিত দুই নেতা হলেন— মাওলানা আ ন ম শামসুল ইসলাম ও শাহজাহান চৌধুরী। এর মধ্যে শামসুল মহানগর জামায়াতের সাবেক আমির এবং শাহজাহান চৌধুরী সাবেক নায়েবে আমির। বর্তমানে কারাবন্দি এই দুই নেতা চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য।
২০০১ সালের অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির তৎকালীন প্রভাবশালী নেতা কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন শাহজাহান চৌধুরী। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী জরুরি অবস্থার সময় দুর্নীতির দায়ে দণ্ডিত হন তিনি। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শাহজাহান চৌধুরী মনোনয়ন পাননি। সেই নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শামসুল ইসলাম। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরু তখন থেকেই। দ্বন্দ্বের জেরে দুই নেতা চট্টগ্রাম মহানগর কমিটিতে তাদের পদও হারিয়েছেন।
জামায়াতপন্থি বুদ্ধিজীবী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘জামায়াতের জন্ম পাকিস্তানে। একই নামে একই আদর্শের দল বিশ্বের আরও অনেক দেশে আছে। ভিন্ন নামে একই আদর্শের দলও আছে। কোথাও জামায়াতের মধ্যে এই ধরনের নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের ইতিহাস নেই। বিরোধটা যদি চট্টগ্রামের দু’জন নেতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে সংকট বেশি হতো না। কিন্তু সেটা কর্মীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে এবং প্রকাশ্য হয়ে যাচ্ছে। জামায়াত এমনিতেই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। এই অবস্থায় বিরোধ সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।’
সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই নেতার বিরোধ সামলাতে গত বছর জামায়াতের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তাদের সংসদীয় আসন ভাগ করে দেওয়া হয়। শামসুলকে চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) ও শাহজাহান চৌধুরীকে চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং ও বন্দর) আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। তবে শাহাজান চৌধুরী ও তার অনুসারীরা কেন্দ্রের এই নির্দেশ গ্রহণ করেননি।
একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন থেকে দলের নির্দেশে মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির আ ন ম শামসুল ইসলাম। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন শাহজাহান চৌধুরীও। মনোনয়ন না পেলে শাহজাহান চৌধুরী শেষ পর্যন্ত নাগরিক কমিটির ব্যানারে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ওই আসনে নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন অনুসারীরা।
এদিকে, দলীয়ভাবে শাহজাহান চৌধুরীর জন্য চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং) আসন থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে নির্বাচন করতে শাহজাহান চৌধুরী আগ্রহী নন বলে কেন্দ্রকে জানিয়ে দিয়েছেন তার অনুসারীরা।
জানতে চাইলে শাহজাহান চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ লোহাগাড়ার আমিরাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এনামুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রকে বলেছি, চট্টগ্রাম-১০ আসন বিএনপির আসন। সেখানে আমির খসরু-নোমান সাহেবের মতো শীর্ষ নেতা নির্বাচন করতে আগ্রহী। তারা কি আসনটি ছাড়বে? তাহলে শাহজাহান সাহেব সেখানে স্বতন্ত্র ইলেকশন করে লাভ কী হবে? কেন্দ্র থেকে যদি শাহজাহান সাহেবকে ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমর্থন এনে একক প্রার্থী করতে পারে, তাহলে তিনি ইলেকশন করবেন। না হলে তিনি নাগরিক কমিটির ব্যানারে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া থেকে নির্বাচন করবেন।’
সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসন থেকে শাহজাহান চৌধুরীর পক্ষে মনোনয়ন ফরম নেওয়ার বিষয়ে ভূমিকা রেখেছে ‘সাতকানিয়া-লোহাগাড়া নাগরিক কমিটি’। এই আসন থেকে আবদুল জব্বার নামের এক ব্যক্তি চালানের মাধ্যমে টাকা জমা দিয়ে তার পক্ষে মনোনয়ন ফরম নেন। এসময় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক উপস্থিত ছিলেন।
সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় শাহজাহানের অনুসারীদের অভিযোগ, ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে শামসুল ইসলাম কৌশলে শাহজাহানের অনুসারীদের সব ধরনের পদ-পদবি থেকে সরিয়ে দেন। পদবঞ্চিতরা ১০ বছর আগে নাগরিক কমিটি গঠন করেন।
শামসুল ইসলামের অনুসারী সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের আমির আবুল ফয়েজ বলেন, শামসুল ইসলামকে কেন্দ্র থেকে সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তিনি দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাননি। কিন্তু শাহজাহান চৌধুরী চট্টগ্রাম-১০ আসনের পাশাপাশি সাতকানিয়া থেকে কেন মনোনয়ন ফরম নিলেন? এর মাধ্যমে তো তিনি দলের সিদ্ধান্ত অম্যান্য করলেন।
আদালতের রায়ে নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় একাত্তরে যুদ্ধাপরাধে জড়িত জামায়াতে ইসলামী এবার দলীয়ভাবে নির্বাচন করতে পারবে না। দুই নেতার মধ্যে বিরোধ না মিটলে নিজেদের ঘাঁটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও নির্বাচনের ফল পক্ষে আনতে পারবে না বলে মনে করছেন জামায়াতের রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা।
তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান মনে করছেন, কেন্দ্র থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রার্থী ঘোষণা করা হলে দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব মিটে যাবে। শেষ পর্যন্ত দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কেউই যাবেন না।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব যতটুকু, তার চেয়েও কর্মীদের মধ্যে আবেগ বেশি। এই আবেগের কারণেই সমস্যাটা প্রকাশ্য হয়েছে। এরপরও এটা মিটে যাবে বলে মনে করছি। দেশের প্রায় ৯০ লাখ মানুষ জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছে। দুই নেতার দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত হয়তো দলটির রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারবে না।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর