Thursday 15 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ওয়াসার পানি জারে, স্তরে স্তরে মুনাফা ৫০০%


৯ জানুয়ারি ২০১৮ ০৯:৪৯ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ১৮:৪৮

মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: স্রেফ ওয়াসার পানি জারে ভরে তা বাজারে ১০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। জার কেনার যৎসামান্য পুঁজি, পানি ভরার ও দোকানে দোকানে পৌঁছানোর সামান্য শ্রম ও ব্যয় দিয়েই রাজধানীতে চলছে কোটি টাকার ‘মিনারেল ওয়াটার’ ব্যবসা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে- বিষয়টি দেখার কেউ নেই। সারাবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে জারের পানিতে থাকছে মলের জীবানু। রাজধানীর বাসাবাড়িগুলোতে ওয়াসার পানি সিদ্ধ করে পান করার অভ্যাস থাকলেও, ‘মিনারেল ওয়াটার’ এই বিবেচনায় জারের পানি সরাসরি পান করছে রাজধানীবাসী। বিশেষ করে যারা বাইরে খাবার গ্রহণ করেন তারা নিরাপদ ভেবে জারের পানি পান করছেন, যা মূলত তাদের ফেলছে নানা ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব পানিতে রয়েছে মলমূত্রের জীবানু।

বিজ্ঞাপন

রাজধানীর বিভিন্ন অংশে যারা জারের পানি সরবরাহ করছে তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এদের প্রায় সকলেই স্রেফ ওয়াসার পানি জারে ভরে বিক্রি করছেন।

বাড্ডার আনন্দনগর এলাকার মজিবর সাত বছর ধরে পানির ব্যবসা করেন। পার্শ্ববর্তী আফতাবনগর এলাকার একটি কোম্পানি থেকে জারভর্তি পানি কিনে তা মহল্লার চায়ের দোকান, অফিস কিংবা বাসা-বাড়িতে পৌঁছে দেন তিনি।

কেবল তিনিই নন এ এলাকায় আরও বেশ কয়েকজন রয়েছেন যারা দীর্ঘদিন ধরে এ ব্যবসায় নিয়োজিত। সারাবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, ১৯ লিটারের প্রতিটি জার তিনি কিনে আনেন ১০ টাকায়। ২৫ থেকে ৩০ টাকায় তা বিক্রি করেন গ্রাহকের কাছে। এ পানির মান কী তা তিনি জানেন না। মানুষ চায় তাই তিনিও বিক্রি করেন। নিজের বাসায়ও এ পানি পান করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

মজিবরের কথাতেই জানা গেলো তিনি ১০ টাকায় কিনে ১৯ লিটারের জার বিক্রি করছেন ৩০ টাকায়। ১০ টাকা লগ্নি করে তার আয় হচ্ছে ২০০%। মজিবরের বিক্রি অনুযায়ী প্রতি লিটারের দাম পড়ছে ১ টাকা ৫৭ পয়সা। আর ঢাকাবাসী জানে হোটেলে হোটেলে প্রতি গ্লাস পানি বিক্রি হয় ১টাকা দরে। এক লিটারে চার গ্লাস পানি হলে তা বিক্রি হচ্ছে ৪ টাকায়। ফলে প্রতি লিটারেই মুনাফা করছে  ২ টাকা ৪৩ পয়সায়। সে হিসাবে হোটেল মালিক কিংবা দোকানদার প্রতি জার কিনে মুনাফা করছেন লগ্নিকৃত অর্থের চেয়ে ১৫৪% বেশি। এই হিসাবে দুই ধাপেই মুনাফা বাড়ছে ৩৫৪%। কোথাও কোথাও প্রতি গ্লাস ২টাকা দরেও বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে মুনাফা ৫০০% ছাড়িয়ে যায়।

কেবল বাড্ডা এলাকাই নয়। একই চিত্র দেখা মিলল শহরের বাণিজ্যিক এলাকা থেকে শুরু করে প্রতিটি আবাসিক এলাকায়। তবে জারের পানির চাহিদা অপেক্ষাকৃত অল্প আয়ের মানুষ যে এলাকায় বসবাস করেন সে এলাকায় বেশি। যেসব এলাকায় ওয়াসার পানি সরবরাহ কম কিংবা অনিয়মিত তারা খাবার এবং রান্নার কাজে এ পানি ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া ফ্লাট বাড়িতে যারা যান্ত্রিকভাবে পানি বিশুদ্ধ করতে চান না তারাও জারের পানি খাচ্ছেন বলে জানান এ ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংক এলাকা থেকে ফকিরাপুলের দিকে যেতে চোখে পড়ে মাসাফি নামের একটি পানির কারখানা। ছোট্ট একটি রুমে জারে পানি ভরছেন কর্মী ছাইদুল। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখানে ওয়াসার পানিই সরাসরি জারে ভরে বাজারজাত করা হয়। এখানে পানি প্রক্রিয়ার জন্য একটি প্লান্ট থাকলেও সেটি সব সময় ব্যবহার করা হয় না। আশপাশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোই তাদের গ্রাহক। এখন শীতকাল তাই প্রতিদিন দেড় থেকে দু শ’ জার সরবরাহ করে থাকেন তারা। গরমে এ চাহিদা বাড়ে।’

রামপুরা এলাকার রিনা হোটেল। সেখানে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ জার পানি প্রয়োজন। পাশের ডিআইটি এলাকার একটি কারখানা থেকে আসে সে পানি। তবে এ পানি ওয়াসার নাকি ভুগর্ভস্থ সে বিষয়ে কোনো ধারণা নেই হোটেল কর্তৃপক্ষের।

রিনা হোটেলের ম্যানেজার আবু বকর জানান, এখন পানির চাহিদা কম। গরমে তাদের আরও বেশি পানি লাগে। কোম্পানির গাড়িতে তাদের এখানে পানি দেওয়া হয়। ১০ টাকায় উনিশ লিটার পানির জার কিনেন। গ্রাহকের কাছ থেকে প্রতি গ্লাস পানির দাম নেওয়া হয় ১টাকা করে।

জহুরুল ইসলাম সিটির ভুইয়া বাড়ি মোড় থেকে ভেতরে গেলে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান। রাতের বেলা কথা হয় দোকানি মোতালেব শেখের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘দোকানে পানির জার রাখি। বাসায়ও অনেকদিন ধরে এই পানি খাই। পানি ফুটানোর ঝামেলা কে করে। মাঝে মাঝে লাইনে পানি পাই না তাই জারের পানিই ভাল ‘

সরিজমিনে রাজধানীর ফকিরাপুল, কমলাপুর, রামপুরা, খিলগাঁও, বাড্ডা, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু পানির কারখানা দেখা গেছে, যার অধিকাংশই ওয়াসার পানি সরবরাহ করে। তারা নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো মানহীন পানি সরবরাহ করছে। কিছু কারখানা অনেক আগে অনুমোদন নিয়ে চালু করলেও এখন তাদের মেয়াদ ফুরিয়ে গেছে। কারখানার পরিবেশও বিশুদ্ধ পানি উৎপাদনের উপযোগী নয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জারে পানি ভরার আগে তা হাইড্রোজেন পার অক্সাইড দিয়ে পরিষ্কার করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কারণ, শুধু ডিটারজেন্ট দিয়ে দৃশ্যমান ময়লা হয়তো পরিষ্কার হয়, পানিবাহিত রোগজীবাণু ধ্বংস হয় না। পাশাপাশি জারে পানি ভরার জন্য দরকার আল্ট্রাভায়োলেট-রে প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ফিলিং মেশিন। কারখানায় উৎপাদিত প্রতি ব্যাচ পানি একজন কেমিস্টকে দিয়ে পরীক্ষার পর তা বাজারজাত করারও নিয়ম রয়েছে। কিন্তু দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোথাও এসব নিয়ম মানা হয় না।

কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রোগ্রামার অফিসার এমদাদ হোসেন মালেক বলেন, ‘ফিল্টার পানির ব্যবসায়ীরা জারের মুখগুলো ট্যাপ করে না মাত্র ৬৫ পয়সার বিনিময় প্রতি পিস ঢাকনা কিনে জারে আটকিয়ে দোকানগুলোতে পানি সরবরাহ করছেন যা স্বাস্থ্য সম্মত নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই জারের ভেতরের ময়লা পরিষ্কার না করে পানি রিফিল করা হচ্ছে। ফলে সহজেই কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ।’
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)’র চেয়ারম্যান নাসির খান বলেন, ‘জারের পানির ব্যবসা এখন সিন্ডিকেটের কবলে। মূলত তারা ওয়াসার পানি খাওয়ায়। এতে করে রাজধানীবাসী ওয়াসার পানি থেকে যেমন বঞ্চিত হয় তেমনি টাকা দিয়ে জীবাণুযুক্ত পানি খায়।’

সারাবাংলা/এমএস/আইজেকে/এমএম

 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর