বেকায়দায় নাজমুল হুদা
২২ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:৪৬
।। আব্দুল জাব্বার খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: আদালতের রায়ের পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে সাবেক মন্ত্রী, সাবেক বিএনপি নেতা ও বর্তমান তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার। হাইকোর্ট বিভাগ তাকে চার বছরের কারাদণ্ড দেওয়ায় নির্বাচনে নাজমুল হুদা অযোগ্য বিবেচিত হবেন বলেই ধারণা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের। এছাড়াও গত ১৮ নভেম্বর সাজার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ায় বেকায়দায় পড়েছেন ব্যারিস্টার নাজমুল।
তবে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করলে এবং আপিল বিভাগ নির্দেশনা দিলে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন প্রবীণ এই রাজনীতিক।
ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে দায়েরের মামলায় গত ১৮ নভেম্বর নাজমুল হুদাকে দণ্ড দিয়ে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন আদালত। রায়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাকে ৪ বছরের কারাদণ্ড এবং তার স্ত্রী অ্যাডভোকেট সিগমা হুদাকে তার কারাভোগকালীন সময়কে সাজা হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
মোট ৬৭ পৃষ্ঠার রায়ে নাজমুল হুদাকে সাজা ভোগ করার জন্য বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিম্ন আদালত রায়ের কপি পাওয়ার ৪৫ দিনের মধ্যে তাকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে নাজমুল হুদাকে গ্রেফতারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিচারিক আদালতকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এর ফলে নাজমুল হুদা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে গেলেন বলে মনে করেন আইনজীবীরা। তাদের মতে, নির্বাচনে অংশ নিতে হলে নাজমুল হুদাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এরপর কারাগার থেকে তাকে সাজার বিরুদ্ধে আপিল করতে হবে। আপিলে আদালত নির্দেশনা দিলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে।
নাজমুল হুদা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না- জানতে চাইলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান সারাবাংলাকে বলেন, সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২(ঘ) অনুযায়ী, আমি মনে করি তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। এটা আমার নিজস্ব আইনি অভিমত।
তিনি বলেন, নিম্ন আদালতের রায়ে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, উচ্চ আদালতের রায়ে সে সাজা থেকে খালাস পেতে হবে অথবা উচ্চ আদালতে সেই সাজা স্থগিত হতে হবে। তবেই তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। যেহেতু উচ্চ আদালতের রায়ে তাকে চার বছরের সাজা দেওয়া হয়েছে, তাই নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাকে সর্বোচ্চ আদালত থেকে বেকসুর খালাস পেতে হবে।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সারাবাংলাকে বলেন, এই রায়টা অনেক আগেই প্রকাশ হওয়া উচিত ছিল। এটা না হয়ে আমার ভীষণ অসুবিধা হয়েছে।
এটা নির্বাচনে বাধা সৃষ্টি করবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, জানি না। দেখা যাক। রায়ের কপি হাতে পেয়েছি, এখন পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ নেব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন করতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। মামলা মোকদ্দমা আগে শেষ করি। এই মামলায় আগে আমি খালাস পেয়েছিলাম।
আরও পড়ুন: নাজমুল হুদার তৃণমূল বিএনপিকে নিবন্ধন দেওয়ার নির্দেশ
নির্বাচনে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন জানিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন চেয়েছি। এখন তারা কী করে দেখি।
সাবেক এ মন্ত্রী বলেন, আমাকে খুব তড়িঘড়ি করে মুভ করতে হবে। কারণ এটা যেহেতেু এখন বিচারিক আদালতে যাবে। তাছাড়া আমি জানলাম কী রায় হয়েছে। এতদিন পর্যন্ত আমি জানতে পারিনি, কারণ রায় দেওয়া হয়নি। হলে হয়তো আমি স্ট্যান্ড (পদক্ষেপ) নিতে পারতাম, এমনকি নির্বাচন কমিশনেও স্ট্যান্ড নিতে পারতাম। এতদিন যেহেতু রায়ই হয়নি, তাহলে আমাকে কনভিকটেড ধরা হবে কেন- দণ্ডপ্রাপ্ত ধরাই বা হবে কেন- প্রশ্ন তোলেন নাজমুল হুদা।
ব্যারিস্টার হুদা আরও বলেন, এই রায়ের মধ্যেই আছে ৪৫ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে সারেন্ডার করতে হবে। ৪৫ দিন কেন, এটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো আমি সারেন্ডার করতে পারব। সারেন্ডার করে আমি আমার মতো লিগ্যাল স্টেপ নিয়ে রায়টাকে স্থগিত করার স্টেপ নিতে পারব। তাছাড়া গভর্নমেন্ট ইচ্ছা করলে সাজাটা স্থগিত করে দিতে পারে।
তার আসন থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী দু’জনকে এই জন্য দায়ী করেন নাজমুল হুদা। এর সঙ্গে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকেও তিনি দায়ী করেন।
প্রায় এক যুগ আগের মামলাটিতে ৭ বছরের সাজা কমিয়ে ৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে গত বছরের ৮ নভেম্বর এই রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট বিভাগ।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, দুর্নীতি একটি অভিশাপ। সমাজের সর্বত্রই দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে। কোনো সরকারি কর্মচারীর দুর্নীতি শুধু সমাজের ভিত্তিকেই বিনষ্ট করে না, তা জাতীয় স্বার্থ ও অর্থনীতির জন্যও ক্ষতিকর। যখন একজন ব্যক্তি সরকারের কোনো শীর্ষ পদে যায় এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে, তখন ওই দুর্নীতি দেশের অর্থনীতি, জাতীয় স্বার্থ ও ভাবমূর্তির ব্যাপক ক্ষতি করে।
খালেদা জিয়ার সরকারের দুই বারের মন্ত্রী নাজমুল হুদা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যও ছিলেন। পরে বিএনপি থেকে বেরিয়ে তিনি প্রথমে বিএনএফ গঠন করেন, ওই দলের কর্তৃত্ব হারানোর পর তিনি গঠন করেন তৃণমূল বিএনপি। এখন ওই দল নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়ে ঢাকা-১৭ আসনে প্রার্থী হতে চাইছেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২১ মার্চ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপ-পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় মামলাটি দায়ের করেন।
মামলায় অভিযোগ আনা হয়, সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘খবরের অন্তরালে’র জন্য মীর জাহের হোসেন নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেন নাজমুল হুদা ও তার স্ত্রী সিগমা হুদা। ২০০৭ সালের ২৭ অগাস্ট বিশেষ জজ আদালতে এই মামলায় নাজমুল হুদাকে ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং আড়াই কোটি টাকা জরিমানা করেন। পাশাপাশি তার স্ত্রী সিগমা হুদাকে ৩ বছরের দণ্ড দেন।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে নাজমুল হুদা ও সিগমা হুদা আপিল করলে ২০১১ সালের ২০ মার্চ হাইকোর্ট বিভাগ তাদের খালাস দেন। রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদক ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে গেলে উভয় আবেদনের শুনানি করে সর্বোচ্চ আদালত ২০১৪ সালের ১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের রায় বাতিল করে পুনঃশুনানির নির্দেশ দেন।
পরে মামলাটি ফের শুনানি নিয়ে গত বছরের ৮ নভেম্বর হাইকোর্ট বিভাগ নাজমুল হুদার ৭ বছরের সাজা কমিয়ে ৪ বছরের কারাদণ্ড দেন।
সারাবাংলা/এটি