‘গায়েবি মামলাকারী পুলিশের পক্ষে কতটা নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব?’
২২ নভেম্বর ২০১৮ ২২:৩৯
।। গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: তফসিল ঘোষণার আগে যে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, তফসিল ঘোষণার পরে তাদের পক্ষে রাতারাতি পাল্টে গিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন কতটা সম্ভব এই প্রশ্ন তুলেছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার।
বৃহস্পতিবার (২২ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক বিশেষ সভায় ইসি কমিশনার মাহবুব চার পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্যে এসব প্রশ্ন তোলেন।
পরপর দুবার কমিশন সভায় নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া আলোচিত কমিশনার মাহবুব তালুকদার মিডিয়ার অনুপস্থিতে দেওয়া বক্তব্যের একটি কপি সারাবাংলার হাতে রয়েছে। সিইসির সভাপতিত্বে সভায় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, আইজিপি, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক, ডিএমপি কমিশনারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গাজীপুর সিটি নির্বাচনে পুলিশের ভূমিকা প্রসঙ্গে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘গাজীপুরে নির্বাচনকালে ইউনিফরমধারী পুলিশ ও সাদা পোষাকের পুলিশ অনেক ব্যক্তিকে বাসা থেকে কিংবা রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ আছে। অনেককে অন্য জেলায় নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের একজন ছাড়া পুলিশ অন্যদের গ্রেফতারের বিষয়ে কোনো স্বীকারোক্তি করেনি। নির্বাচনের পর দেখা যায় তাদের ১০ জনকে অন্তত কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাওয়া গেছে’। মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘গ্রেফতার না করলে তারা কারাগারে গেলেন কীভাবে? এ প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি’।
সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত গায়েবি মামলা প্রসঙ্গে মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘বর্তমানে বহুল প্রচলিত গায়েবি মামলা এখন আর গায়েবি আওয়াজ না। মাননীয় হাইকোর্ট পর্যন্ত এ ধরনের মামলাতে পুলিশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয় বলে উল্লেখ করেছেন। ঢাকার পুলিশ কমিশনার মহোদয় মহোদয় পুলিশ বাহিনীকে গায়েবি মামলা না করতে নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও অনেক ক্ষেত্রে এরূপ মামলা চালু রয়েছে’। আমার প্রশ্ন হলো সিডিউল ঘোষণার পূর্বে যে পুলিশ গায়েবি মামলা করেছে, সিডিউল ঘোষণার পরে তার পক্ষে রাতারাতি পালটে গিয়ে নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন কতটা সম্ভব? এ প্রশ্ন মনে জাগে’। তিনি বলেন, ‘পুলিশ বাহিনী নির্বাচনে সবচেয়ে বড় সহাযক শক্তি। তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে’।
ইসি কমিশনার বলেন, ‘কিছু সংখ্যাক গায়েবি মামলার আসামিদের তালিকা বিরোধী দল থেকে নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। যদিও অধিকাংশই পুরনো মামলা। এসব মামলা অজ্ঞাতনামা আসামিদের অনেকের আদালত থেকে জামিন নেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না। কোনো কোনো সম্ভাব্য প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা থাকার কারণে তারা নির্বাচনী প্রচারকাজ চালাতে ভয় পাচ্ছেন। এহেন ভয়ভীতি অমূলক নয়। নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে স্বাভাবিক রাখার স্বার্থে নির্বাচন পূর্ব সময়ে প্রার্থীরা যাতে হয়রানির শিকার না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এ সর্ম্পকে নির্বাচন কমিশন থেকে যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা যথাযথভাবে পালন করা প্রয়োজন’।
ইসি কমিশনার বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে মিডিয়ায় যে বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে তা হলো, নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহে পুলিশ দুই মাস পূর্ব থেকে মাঠে নেমেছে। তারা প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পুলিং কর্মকর্তাদের বিষয়ে নানারুপ তথ্য সংগ্রহ করছে এবং জিজ্ঞাসাবাদ করছে। এই তথ্যানুসন্ধানের বিষয়ে পুলিশকে কোন নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কমিশন নির্বাচন কর্মকর্তাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য কোনো নির্দেশনা দেয়নি। সুতরাং এসব কর্মকাণ্ড কে কি উদ্দেশ্যে করছে তা রহস্যজনক। বলা বাহুল্য অতি উৎসাহী কিছু পুলিশ সদস্যের এই কর্মকাণ্ডে ব্যাপক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে, যার দায় নির্বাচন কমিশনের ওপর এসে পড়ে’। তিনি বলেন, ‘আমরা কোনভাবেই এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দিতে পারি না। আর একথা সত্য যে আমরা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তার দায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর বর্তাবে এবং আপনারা প্রশ্নবিদ্ধ হলে আমরা দায় এড়াতে পারবো না’।
মাহবুব তালুকদার বরিশাল সিটি নির্বাচন অনিয়ম প্রসঙ্গে বলেন, “কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিরোধী প্রার্থীদের পুলিশ অযাচিতভাবে হয়রানি করা হয়েছে। আবার সরকারি দলের প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় পুলিশকে নিষ্ক্রীয় থাকতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয় উল্টো বিরোধী প্রার্থীর প্রচারি প্রচারণায় পুলিশের অযাচিত হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে”। তিনি বলেন, “বরিশাল সিটি নির্বাচনের ভোট বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সব কমিশনার একমত হলেও নির্বাচন বন্ধ করলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবে কিনা এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হবে কি না তা ভেবে নির্বাচন বন্ধ করা থেকে আমরা বিরত থাকি’।
মাহবুব তালুকদার বলেন, ‘১৯৭০ সালে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালে তৎকালিন জাতীয় নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। নির্বাচন বিষয়ে সেটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। নির্বাচন কমিশনে যোগদানের পর সেই অভিজ্ঞতা দিনে দিনে ফুলে পল্লবে পরিণত হয়েছে’।
উল্লেখ্য ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ২৮ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র যাচাই বাছাই ২ ডিসেম্বর, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ ৯ ডিসেম্বর এবং প্রতীক বরাদ্দ ১০ ডিসেম্বর।
সারাবাংলা/জিএস/এমআই