নির্বাচন ভাবনা: সংঘাত নয়, নিরবচ্ছিন্ন পরিবেশ চান ব্যবসায়ীরা
২৪ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:২২
।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও থাকলেও এর পরের চার বছর দেশে তেমন কোনো রাজনৈতিক সংঘাত ছিল না। এমনকি একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশে আবারও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির আশঙ্কা বিভিন্ন মহল থেকে করা হলেও দেশে তেমন কিছুই হয়নি।
গত চার বছর ধরে দেশে অন্তত ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ বজায় ছিল। একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। বন্ধ ছিল না দেশের ‘লাইফ লাইন’ খ্যাত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কও। এর ফলে এগিয়ে গেছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্যসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতি।
কিন্তু নির্বাচনের একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে অথবা নির্বাচনের পর পরাজিত দল দেশে আবারও সংঘাতের রাজনীতি ফিরিয়ে আনবে কি-না, সেটাই এখন ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কাছে শঙ্কার বিষয়। দেশের বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা বলেছেন, তারা একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন প্রত্যাশা করেন। সংঘাতের রাজনীতির অবসান চান। যে দলই ক্ষমতায় আসুক, দেশে যেন ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ থাকে, এটাই ব্যবসায়ীদের চাওয়া।
বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সঙ্গে কথা বলে তাদের এই বক্তব্য পাওয়া গেছে।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম দেশে আবারও কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি আসবে, এমন আশঙ্কা মাথায়ও আনতে চান না।
চেম্বার সভাপতি সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৩-১৪ সালে আমরা দেশে অনেক সংঘাত দেখেছি। আগেও দেখেছি। এমন সংঘাতের রাজনীতি আমাদের কাছে কখনোই কাম্য নয়। এটা ঠিক যে ২০১৪ সালের পর আমরা একটি স্থিতিশীল সরকার এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি পেয়েছি। সে জন্য আমরা গত পাঁচবছর ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যবসা করতে পেরেছি। এই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আমরা নির্বাচনের পরেও দেখতে চাই। কোনো ধরনের শঙ্কাবোধ করতে চাই না, শুধু চাই যারাই ক্ষমতায় আসুক, তারা যেন সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলেমিশে দেশে ব্যবসার পরিবেশটা বজায় রাখতে পারে।’
ব্যবসায়ীদের সর্বোচ্চ সংগঠন এফবিসিসিআই ও চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক সৈয়দ আমিরুল হক ভাঙচুর-তাণ্ডবের রাজনীতির চিরতরে অবসান চান। তবে তিনি এও মনে করেন দেশের রাজনীতিতে যেসব শিক্ষিত তরুণদের প্রবেশ ঘটছে, তারা দেশে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করবে। তারা বাস পোড়ানোর রাজনীতি করবে না।
আমিরুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়। তারা রাজনৈতিক দলের মধ্যে হানাহানি চায় না। ছাত্র-যুব রাজনীতির নামে মাস্তানি-চাঁদাবাজি চায় না। আমরা যারা ব্যবসা করি, আমরাও চাই না। কারণ আজ দেশ যতটুকু এগিয়ে গেছে তার বড় অবদান প্রাইভেট সেক্টরের। আগামী দিনে যারা দেশে রাজনীতি করবে, তারা অবশ্যই অর্থনীতিকেই সামনে রেখে করবে।’
‘কারণ দেশে আগামী পাঁচ বছরে অনেক উচ্চশিক্ষিত তরুণের রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটবে। তারা রাস্তায় বাস পোড়ানোর রাজনীতি করবে না। তারা টক-শো করবে। সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা করবে, অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করবে। এমন রাজনীতি বাংলাদেশে আসবেই’ যোগ করেন আমিরুল হক
২০১৩ সালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচারকে কেন্দ্র করে জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালে দেশজুড়ে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। লাগাতার সেই সহিংসতা অব্যাহত ছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত। সেই নির্বাচন প্রতিরোধ করা নিয়েও দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও, হানাহানি ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৫ সাল পর্যন্ত সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে লাগাতার অবরোধ পালন করে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ব্যাপক হতাহতের পর একপর্যায়ে অবরোধ স্তিমিত হয়ে যায়। এরপর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত দেশে কোনো হরতাল-অবরোধ ছিল না।
বিজিএমইএ’র সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী বলেছেন, সংঘাতের রাজনীতি না থাকায় গত ৪-৫ বছরে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হয়েছে দেশের পোশাক শিল্প। রফতানিতে এই শিল্প অনেক এগিয়ে গেছে।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাই শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনটা হোক। একটা নির্বাচন হয়ে গেলে এবং সরকার গঠন করে ফেলার পর আশা করছি আর কোন সমস্যা থাকবে না। ধ্বংসাত্মক রাজনীতি দেশে ফিরে আসুক, এটা আমাদের কখনোই কাম্য নয়।’
জুনিয়র চেম্বার, চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি মো. গিয়াস উদ্দিনের বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে আর কোনো সংঘাতের শঙ্কা নেই। নির্বাচনটা হয়ে যাবে। তবে শঙ্কাটা আছে নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে।’
গিয়াস উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশ আছে। শুধু নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে একটা ঘটনা ছাড়া আর কিছুই হয়নি। কিন্তু নির্বাচনে যে পার্টি হারবে, তারা যদি ফলাফর না মানে তখন কী হবে ? নির্বাচনটা হবে একেবারে নতুন বছরকে সামনে রেখে। নতুন বছরে যদি আবারও ২০১৩-১৪ সালে আমরা যেরকম পেট্টোল বোমার আন্দোলন দেখেছি, সেই আন্দোলন যদি ফিরে আসে, তখন তো দেশের অর্থনীতি আবারও ভেঙে পড়বে। আমাদের নিরবচ্ছিন্ন ব্যবসার পরিবেশটা তো থাকবে না।’
‘নির্বাচন যা-ই হোক, আমরা আর কোনোভাবেই পেছনের দিকে ফিরে যেতে চাই না। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে, আমার গাড়ি কেউ পুড়িয়ে দিচ্ছে, সেই দৃশ্য আমরা আর দেখতে চাই না। আমরা এই ধ্বংসাত্মক রাজনীতি থেকে পরিত্রাণ চাই’বলেন তরুণ এই ব্যবসায়ী নেতা
জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতির বিদায় চান তরুণ শিল্পপতি ও মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মো. সরওয়ার আলম।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে- এটা আমরা চাই। কারণ দেশটা আপনার-আমার একার কিংবা কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের নয়। দেশটা সবার। এই দেশের উন্নয়ন মানে সব জনগণের উন্নয়ন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর আমরা গত পাঁচ বছরে খুব বেশি জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি দেখিনি। সে জন্য ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পেরেছেন। দেশ এগিয়ে গেছে। এভাবেই আমরা এইদেশ থেকে জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতির বিদায় দেখতে চাই।’
চট্টগ্রাম বন্দর এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক কোনভাবেই বন্ধ করা যাবে না, এমনটাই চান আরেক তরুণ ব্যবসায়ী, ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এলবিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা হচ্ছে আমদানি-রফতানি নির্ভর। বন্দর একদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে ডেলিভারি আটকে যাওয়া। ডেলিভারি আটকে গেলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এতে আমার যেমন ক্ষতি, দেশের অর্থনীতিরও ক্ষতি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ বিষয় হচ্ছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। আমাদের কাঁচামাল-উৎপাদিত পণ্য তো এই মহাসড়ক দিয়েই পরিবহন করা হয়। এখন কথায় কথায় যদি মহাসড়কটা বন্ধ থাকে, তাহলে একদিনে আমাদের যে পরিমাণ লস হয়, সেটা কোনোভাবেই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না এক সপ্তাহেও।’
‘নির্বাচনের পর একদল ক্ষমতায় থাকবে, আরেক দল বিরোধী দলে থাকবে। আমরা চাইব, উভয়পক্ষ যেন ন্যূনতম সমঝোতার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করে। তাদের মধ্যে যেন দেশের অর্থনীতি নিয়ে একটা সমঝোতা থাকে।’
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুশাসন, জবাবদিহিমূলক শাসন দিতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মধ্য দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আল্লাহর ওয়াস্তে হরতাল-অবরোধের রাজনীতি যদি না থাকে, যদি স্থিতিশীল পরিস্থিতি থাকে, তাহলে প্রচুর বিদেশি বিনিয়োগ দেশে আসবে। এতে দেশ আগামী পাঁচ বছরে কতদূর এগিয়ে যাবে, সেটা আমরা এখন কল্পনাও করতে পারব না।’
সারাবাংলা/আরডি/একে