‘যে মানুষ জাতীয় সঙ্গীত গায়, সে জঙ্গিবাদে জড়াবে না’
২৪ নভেম্বর ২০১৮ ২১:২২
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: যে মানুষ প্রাণভরে জাতীয় সঙ্গীত গায়, সে কখনো জঙ্গিবাদে জড়াবে না। যে মানুষ প্রকৃত ধার্মিক, সে জঙ্গিবাদে জড়াবে না—ইসলামে এমন কিছু বলা নেই, বরং ইসলাম শান্তির ধর্ম। একজন মননশীল মানুষ কখনো উগ্রবাদে বিশ্বাসী হবেন না। যারা লালন-নজরুল শোনেন তারা কখনো জঙ্গি হতে পারেন না। মানুষ ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ যাদের রয়েছে, তারা উগ্রবাদী চিন্তাতেই যাবেন না—বলে মন্তব্য করেছেন কাউন্টার ট্যারোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মনিরুল ইসলাম।
আজ শনিবার (২৪ নভেম্বর) ‘সহিংস উগ্রবাদ বিরোধী যুব সংলাপ’ নামের এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। ইউএনডিপির সহযোগিতায় অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে সিটিটিসি।
সহিংস উগ্রবাদ প্রতিরোধে তরুণদের ভূমিকা, জঙ্গিবাদ তথা উগ্রবাদের সমস্যার কারণ এবং এ সমস্যার সমাধানে তরুণদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত, সে বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষদের নিয়ে এ সংলাপের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, তরুণদের প্রধান অভিযোগ—তাদের কথা কেউ শুনতে চায় না বা শোনে না, বড়দের ভাষ্যটাই তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর তাই সে অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে আমরা তরুণদের কথা শুনতে চাই, কেন তরুণরা উগ্রবাদে জড়িয়ে যাচ্ছে এবং তারা এই সহিংস উগ্রবাদ থেকে পরিত্রাণ পেতে কী ভাবছে, তরুণদের ফেরানোর উপায় কী, তা জানতে চাই।
অনুষ্ঠানে জঙ্গিবাদের কারণ হিসেবে ধর্মের অপব্যাখ্যা বা ভুল ব্যাখ্যা, প্যারেন্টিং, মা বাবার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সর্ম্পক না থাকা, পারিবারিক শিক্ষার অভাব, আত্মীয়তার বন্ধন, বঞ্চ ঞ্চনা, মানসিক অবসাদ, ইন্টারনেট আসক্তি, দারিদ্র এবং বেকারত্ব, একঘেয়েমি মানসিকতা, একাকীত্ব, লেখাপড়ার চাপ, মুক্তচিন্তা প্রকাশে অভাব, পারিবারিক বাধা, সাংস্কৃতিক বিকাশ বা খেলাধুলার পরিবেশ না থাকার মতো বিষয়গুলো উঠে আসে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাউন্সেলিং টিম থাকলে তরুণরা উগ্রবাদ সর্ম্পকে ধারণা পাবে বলেও জানান বক্তারা।
অনুষ্ঠানে লালবাগ মাদ্রাসার শিক্ষক সামসুদ্দীন বলেন, সঠিকভাবে না জেনে অনেক কিছু অন্ধের মতো বিশ্বাস করি, তাতে সহজেই বিপথে চলে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। বদরুন্নেছা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থী রাখী বলেন, খুব বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার, বিষন্নতা, হতাশা এবং বেকারত্ত উগ্রবাদে জড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ আর খেলাধুলা এবং বিনোদনের অভাব রয়েছে আমাদের। একইসঙ্গে সব ধরণের গুজব মোকাবিলা করতে হবে বলেন রাখী।
অনুষ্ঠানে ইউএনডিপির প্রতিনিধি রবার্ট স্টরম্যান বলেন, উগ্রবাদ ও সহিংসতা বিশ্বজুড়ে একটি ক্যান্সার। তাই উগ্রবাদীদের শুধু শাস্তির আওতায় আনলেই হবে না, এসব উগ্রবাদের মূল কারণ কী কী সেগুলোও শনাক্ত করতে হবে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশে সহিংসতা কম উল্লেখ করে স্টরম্যান বলেন, সহিংসতার জরিপে বিশ্বে বাংলাদেশ ২২ নম্বরে।
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মেহের আফরোজ শাওন বলেন, আমাদের অনেক পরিবারে লুকানোর প্রবণতা রয়েছে। কিন্তু শুরুর দিকে যদি কোনো মাদকাসক্ত বা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া কাউকে শনাক্ত করা যায়, তাহলে তাকে সরিয়ে আনা অনেক বেশি সহজ হয়। একইসঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকতে হবে। আমরা কারও উপকার করতে না পারি, কারও যেন ক্ষতি না করি।
অনুষ্ঠানে সাংবাদিক রাজীব ঘোষ বলেন, পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদ বিষয়ক পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করার সময় এসেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের শিক্ষক ড. নীলয় রঞ্জন বিশ্বাস বলেন, পুলিশ বা রাষ্ট্র একা কিছু করতে পারবে না, দায়িত্ব নিজের হাতে নিতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ফারজানা রহমান বলেন, যাদের পরিবারের মধ্যে সহিংসতার ইতিহাস থাকে, যারা মাদকাসক্ত কিংবা বিষন্নতায় ভোগেন, যারা পরিচর্যাহীন শৈশবে বড় হয়, পরিচর্যাহীন মনোজগতে থাকেন তারাই সাধারণত অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে যোগ হয় ধর্মের আধিপত্যবিস্তারের নামে অপব্যাখ্যা, তখন সাধারণভাবে তারাই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে।
মিডিয়া ব্যক্তিত্ব নবনীতা চৌধুরী বলেন, ইন্টারনেটে আসা কোন কন্টেন্ট আমরা গ্রহণ করবো আর কোনটা করবো না—সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ কোনটা ভালো কাজ আর কোনটা খারাপ কাজ সেটাতো আমরা জানি। আমার নিজেকেও যাচাই-বাছাই করতে হবে। আমি কীভাবে আমাকে তৈরি করছি-সেটাও জানতে হবে।
অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, চারপাশকে জানতে হবে, নিজেকে তৈরি করাও খুব জরুরি, বলেন নবনীতা।
সমাপনী বক্তব্যে মনিরুল ইসলাম বলেন, তরুণরা বিভিন্ন ভিডিও গেইমসে যখন নানা ধরণের সহিংসতা দেখে তখন সেগুলো তাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে এবং সে যখন দেখে এই ধরণের অস্ত্রের ব্যবহার বাস্তবেও রয়েছে তখন তার ভেতরের অ্যাডভেঞ্চারিজম তাকে পেয়ে বসে এবং এ থেকে ইরাক-সিরিয়াতেও অনেকে গিয়েছে, জড়িয়েছে উগ্রবাদের সঙ্গে।
সাইবার স্পেস বা ইন্টারনেট রেডিকালাইজেশনের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম উল্লেখ করে মনিরুল ইসলাম বলেন, এখান থেকে কী গ্রহণ করা যাবে কী যাবে না-সেটা শিক্ষা জরুরি। তাই ইন্টারনেট কেবল নিয়ন্ত্রণ করে হবে না, এখানে বাবা-মা থেকে শুরু করে শিক্ষক, সমাজ, সুশীল সমাজ, মিডিয়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরও ভুমিকা রয়েছে। হলি আর্টিজান থেকে শুরু করে প্রতিটি জঙ্গি হামলায় জড়িতদের বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তারা বেহেশতে যাবার একটা সহজ হিসেব মিলিয়েছে। শহীদ হয়ে গেলে আর কোনো হিসাব করা হবে না, কিন্তু এটাতো জেহাদ নয়—এটা বোঝাতে হবে তরুণদের। আমাদের দেশে কী কোনো রোল মডেল নেই, প্রশ্ন করে মনিরুল ইসলাম বলেন, তা না করে একজন লাদেন বা তামিম চৌধুরীকে রোল মডেল করার সুযোগ নেই।
কেমন করে কেউ উগ্রবাদে জড়িয়েছে কি না কী করে বোঝা যাবে বোঝাতে মনিরুল ইসলাম বলেন, কেউ যখন শুধুমাত্র গোপনীয়তা খোঁজে, পরিবারের সঙ্গে সর্ম্পক নেই, হঠাৎ করে একা থাকতে পছন্দ করছে, পুরনো বন্ধুদের বাদ দিয়ে নতুন বন্ধু জুটেছে, সে তার মতামত চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে—তখনই বুঝতে হবে তার কোনো পরিবর্তন হয়েছে। হয় সে রুম বন্ধ করে মাদক নিচ্ছে, নয়তো সে এই রেডিকালাইজেশনে ঝুঁকেছে।
তিনি বলেন, যারা বিভিন্ন ‘টেরর সাসপেক্টস’ হিসেবে আছেন, যারা জামিনে আছে বা ভালোর পথে এসেছে তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের ভয়েস কি, তারা কি মনে করেন সেসব বুঝতে চেয়েছে। হলি আর্টিজান থেকে বিভিন্ন অভিযানে মারা গিয়েছে তাদের পরিবারকে নিয়ে ওয়ার্কশপ করেছি, বুঝতে চেয়েছি তারা কী লক্ষণগুলো দেখেছিলেন। সর্বোপরি নাগরিক হিসেবে সবার দায়িত্ব রয়েছে, সে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
উগ্রবাদী সহিংসতা বা জঙ্গিবাদ দমন কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা কেবলমাত্র কাউন্টার ট্যারোরিজম ইউনিটের কাজ নয়, আমরা কেবলমাত্র একটা অংশ হতে পারি। এখানে ‘কম্প্রিহেনসিভ কাউন্টার ট্যারোরিজম স্ট্রাটেজি’ দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, অনেকগুলো সরকারি বিভাগের কোলাবোরেশন দরকার। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ধর্ম মন্ত্রণালয়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং মিডিয়ার ভূমিকা যৌথভাবে প্রয়োজন, বলেন মনিরুল ইসলাম।
সারাবাংলা/জেএ/এমআই