উঠে যেতে পারে প্রাথমিকে বোর্ড পরীক্ষা
২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:২৫
।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: আগামী ২০১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে উঠে যেতে পারে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি)। বাস্তবতা আর নানামুখি বিতর্ক মাথায় নিয়ে এই প্রক্রিয়া থেকে সরে যেতে পারে সরকার। সম্প্রতি গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের বক্তব্যে এ ব্যাপারে কিছুটা আভাস পাওয়া গেছে। এর আগেও এই পরীক্ষা তুলে দেওয়ার বিষয়ে একাধিকবার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের বক্তব্য পাওয়া যায়। তবে প্রাথমিক শিক্ষার স্তর কোন পর্যন্ত হবে সেটি চূড়ান্ত করতে না পারায় এখনও রয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা।
গত ১৮ নভেম্বর থেকে সারাদেশে একযোগে শুরু হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হবে আগামী ২৭ নভেম্বর। সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা এই দু’স্তর মিলিয়ে মোট পরীক্ষায় মোট নিবন্ধন করে ৩২ লাখ ৪০ হাজার ১৯১ জন শিক্ষার্থী।
তবে প্রথম দিন সব মিলিয়ে অনুপস্থিত ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৩১৬ জন। এদিন পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের জন্য বহিষ্কার করা হয় ৩ শিক্ষার্থীকে।
গত বছরের মতো এবার পিইসি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবে কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত, পরীক্ষা কেন্দ্রে অতিরিক্ত কড়াকড়ি, সকাল থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রভিত্তিক জনসমাগম ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা ভীতি পুরনো চেহারা দেখা যাচ্ছে। এই অবস্থায় পরীক্ষা বাতিলের পুরনো দাবি আবারও নতুন করে সামনে এসেছে।
সেই সঙ্গে অভিযোগ আসতে শুরু করেছে, পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে বাড়তি কোচিং, নোট-গাইড, মডেল টেস্ট ও পড়ার চাপ শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত করছে।
সমালোচকরা বলছেন, প্রাথমিকের শিক্ষাস্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কবে নাগাদ বাস্তবায়ন করা যাবে সে পর্যন্ত এই পরীক্ষা রেখে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বাড়তি ভোগান্তির কোনও মানে হয় না। নতুন শিক্ষাবর্ষ থেকেই এই পদ্ধতি উঠিয়ে দেওয়াই হবে মঙ্গলজনক। এতে করে সরকারের আর্থিক সাশ্রয়ের পাশাপাশি কমবে ঝামেলা। ভোগান্তি থেকে রেহাই পাবে প্রায় কোটি মানুষ।
পঞ্চম শ্রেণিতে ঘটা করে বোর্ড পরীক্ষা নেওয়ার সমালোচনায় মুখর শিক্ষাবিদরাও। তাদের ভাষ্য- উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার মুখোমুখি করার চেয়ে তার শারীরিক-মানসিক বিকাশের ওপর জোর দেওয়া হয়। অথচ আমরা শিশু বয়সেই তাকে এক প্রকার যুদ্ধে নামিয়ে দিচ্ছি। এতে নানা ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনৈতিক চিন্তার প্রবেশ ঘটছে। অভিভাবকরা অতিমাত্রায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হচ্ছেন। প্রশ্নফাঁসের মতো ঘটনা ঘটছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা শুরু হওয়ার পর থেকে প্রশ্নফাঁসের ঘটনা বেড়ে গেছে। এখন শিশু বয়স থেকে এই অনৈতিক চিন্তার হাতেখড়ি হচ্ছে। অথচ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য নৈতিকতার জাগরণ।
প্রাথমিক স্তরে পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বয়সে পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ দিয়ে একটা শিশু কী করবে? এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা কেবল তাদের নয়, তাদের অভিভাবকদেরও অসুস্থ করে তুলছে। বাড়তি চাপ ও খরচতো রয়েছেই। তার মতে, কেবল পিইসিই নয় জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট বা জেএসসি পরীক্ষাও তুলে দেওয়া উচিৎ।
প্রাথমিকে এ ধরনের বৃহৎ পরিসরের পরীক্ষার বিপক্ষে বেশ সরব শিক্ষা গবেষক ও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান। বিভিন্ন সময় এই পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিস্তর লেখালেখিও করেন তিনি। তার মতে, পিইসি পরীক্ষা শিশুদের শৈশব বিনাশী। এই পরীক্ষার ফলে গত এক দশকে অন্তত দুই কোটি শিশুর শৈশব নষ্ট হয়েছে। নতুন করে শিশুদের শৈশব নষ্ট না করতে মূল শিক্ষানীতিতে অনুপস্থিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানান তিনি।
চলমান পিইসি পরীক্ষার একাধিক কেন্দ্র ঘুরে এবং শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরীক্ষা তাদের জীবন-যাপনের ক্ষেত্রে বাড়তি ঝামেলা যুক্ত করেছে। নাগরিক জীবনে যেখানে হাজারো সমস্যার ভেতর দিয়ে যেতে হয়, সেখানে শিশুদের এমন পরীক্ষা এবং পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে আর্থিক খরচ, সময় ব্যয় এবং ঝামেলা পোহাতে গিয়ে তাদের অতিরিক্ত চাপ নিতে হচ্ছে। কর্মজীবী পরিবারগুলোয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অশান্তিও সৃষ্টি করছে এই পরীক্ষা।
অভিভাবকরা বলছেন, ছোট বয়সে এমন বড় পরীক্ষার ফেরে পড়ে শিশুদের চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় থাকতে হয় তাদের। বিশেষ করে প্রত্যেকটা পরীক্ষার আগের রাতে তাদের নির্ঘুম কাটাতে হয়। এমন অহেতুক পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা নেই উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানান তারা।
এদিকে প্রথম দিনের পরীক্ষা পরিদর্শন শেষ প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মন্ত্রিপরিষদ (কেবিনেট) সিদ্ধান্ত দিলেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষা বাতিল করা যাবে।
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার আওতায় আনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকের সমাপনী বলতে আমাদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। তারপরই পরীক্ষা। যেহেতু নানা কারণে এখনও সব অষ্টম শ্রেণির স্কুল আমাদের আওতায় আসেনি, তাই কেবিনেটের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। সিদ্ধান্ত এলেই বন্ধ করা হবে।’
কবে নাগাদ এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসবে, সেই সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তার আগ পর্যন্ত যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়াই এই পরীক্ষা বহাল থাকবে, থাকবে শিক্ষার্থীদের ওপর এই অনাবশ্যক চাপ।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, পিইসি পরীক্ষা একটি বাড়তি চাপ। এর জন্য একটি ছোট শিশুকে যেভাবে পরিশ্রম করতে হয় তা ভীতিকর। এই পরীক্ষার কারণে কেবল শিক্ষার্থীই চাপের মুখে থাকে তা নয়, অভিভাবকদেরও উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হয়। কাজেই আগামী বছর (২০১৯) থেকে পিইসি পরীক্ষার পরিবর্তে শুধু জেএসসি পরীক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
সারাবাংলা/এটি
আরও পড়ুন
প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাতিলের গুজবে ক্ষুব্ধ মন্ত্রণালয়
প্রাথমিক সমাপনী শুরু, পরীক্ষার্থী ৩১ লাখ
প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শুরু ১৮ নভেম্বর