Thursday 15 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চোখগুলো বহু বছরের বঞ্চনার কথা বলে


৯ জানুয়ারি ২০১৮ ১৫:১৭ | আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৮ ১৮:৪৯

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: উদাসভাবে শূন্যে তাকিয়ে আছেন ঝিনাইদহের শৈলকূপার নাসরীন বেগম। দু’চোখে লোনা জলের লুকোচুরি খেলা। শিয়রের সহযাত্রীদের পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। অপরজন পা-দু’টো উষ্ণ কাপড়ে ঢেকে রেখেছেন। প্রচণ্ড শীতে রাজধানীর এই রাজপথে এভাবেই পড়ে আছেন এক-একজন ‘মাদরাসা শিক্ষক’। আমরণ অনশনে অংশ নিয়ে এখন সত্যিই মরণদশা তাদের।

জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে বাংলাদেশ স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষক সমিতির ডাকে শিক্ষকদের আমরণ অনশন চলছে। এতে কয়েক শ’ শিক্ষক অংশ নিয়েছেন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। নাসরীন বেগম তাদেরই একজন।

সারাবাংলার পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে শিয়রে থাকা সহকর্মীদের সহযোগিতায় মাথাটা খানিক উপরে তুলেন নাসরীন। শীতের তীব্রতা থেকে বাঁচতে কানটুপি পরেছেন। চোখ-মুখো খোলা। তবে সে চোখে রাজ্যের হতাশা-বঞ্চনা আর অসহায়ত্বের ছাপ স্পস্ট। ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘শৈলকূপার বড়বাড়ি বগড়া স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাটি ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। আমি গত ২০ বছর যাবত প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক হিসেবে আছি। গত ১ জানুয়ারি ঢাকায় আসি আন্দোলনে। এরপর গতকাল থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছি।’

‘ঢাকায় কোনো আত্মীয় স্বজন নেই। এখানেই পড়ে আছি। অসুস্থ হওয়ার পর এই অপরিচিত সহকর্মীরাই এখন আমার দেখা-শোনা করেন।…’ বলতে বলতে কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। দু’চোখ দিয়ে লোনা জ্বল গড়িয়ে পড়ে।

নাসরীন বেগম বলেন, ‘২০ বছর যাবত পাঠদান করছি। কত ছেলে-মেয়েকে শিক্ষা দিচ্ছি। কিন্তু এখন আর কান্নাও আসে না। চোখে যে পানিটুকু দেখছেন সেটুকু কেবল বঞ্চনার কথা বলে। আমরা আর কত লাঞ্ছিত-বঞ্চিত থাকব…!’ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে হতে যেন একেবারে হারিয়ে যায় তার কথাগুলো।

বিজ্ঞাপন

নাসরীনের শিয়রে যিনি বসে আছেন তার বাড়ি লালমণিরহাটের হাতিবান্ধায়। নাম মোসাম্মাৎ জরিফা বেগম। ১৯৯৯ সাল থেকে একটি মাদরাসায় আছেন। জরিফা বললেন, ‘এখানে আসার পর অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। কার বাড়ি কোথায় সেটি বড় ব্যাপার নয়। আমরা শিক্ষক। আমাদের ভেতরের মনুষ্যত্ব একটু আলাদা। উনি অসুস্থ হওয়ার পর আমরা সারাক্ষণ দেখে রাখছি। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আমরা যে কেউ অসুস্থ হতে পারি।’

জরিফা বেগম বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে আমরা একইসঙ্গে আন্দোলন করেছি। আজ প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি হয়ে গেছে। প্রাইমারিতে যে বই পড়ানো হয় আমরা সেগুলোতো পড়াই তারপর দু’টো আরবী বই বেশি পড়াই কিন্তু আমাদের ভাগ্য আগের মতোই রয়ে গেল। কী অপরাধ আমাদের?’

ক’দিন ধরে সারাদেশে তীব্র শীত। জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। এরইমধ্যে খোলা আকাশের নিচে বসে আছেন কতগুলো অনাহারি শিক্ষক। একটু উষ্ণতার জন্য একে অন্যের সহযোগিতা নিচ্ছেন। সেখানে নাসরীন বেগম অসুস্থ। তাই তার পায়ের দিকটা কোলে নিয়ে বসে আছেন বরিশালের উজিরপুরের শিক্ষক শিউলী পারভীন। শিক্ষকতা অভিজ্ঞতা আর না পাওয়ার গল্পটা অন্যদের মতো প্রায় একই।

শিউলী বললেন, ‘প্রায় একইসঙ্গে আমরা এখানে আন্দোলন শুরু করি। নন-এমপিও শিক্ষকরা তাদের দাবি আদায় করে বাড়ি ফিরে গেছে। আর আমরা এখনো সেই রাস্তায়ই পড়ে আছি। একইদেশে দুই নীতি। এই বিমাতাসূলভ আচরণ দেখে আমাদের শিশুরা কী শিখবে?’ …এভাবেই চোখগুলো বলে চলেছে বহু বছরের বঞ্চনার কথা।

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবিতে শিক্ষকদের অবস্থান কর্মসূচির নবম দিন দুপুর ১২টা থেকে আমরণ অনশনে রূপ নেয়। এ পর‌্যন্ত ১৭ জন অসুস্থ হয়েছেন বলে জানান সংগঠনের মহাসচিব কাজী মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত আমরণ অনশন কর্মসূচি চলবে।’

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এমইউএস/আইজেকে

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর