আসন জয়ের সমীকরণে প্রত্যক্ষ ভোটে পিছিয়ে নারী
২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:৪৯
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ২০২০ সালের মধ্যে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সব স্তরে নারী প্রতিনিধিত্ব ৩৩ শতাংশ রাখার বাধ্যবাধকতা রেখে বিধিমালা প্রণয়ন করে নির্বাচন কমিশন। একমাত্র গণফ্রন্ট ছাড়া দেশের কোনো রাজনৈতিক দলই এখনও সেই বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে পারেনি। ২০২০ সাল আসতে মাত্র দুই বছর বাকি থাকলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোতে নারী প্রার্থীর সংখ্যা হাতেগোণা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের সমীকরণেই প্রত্যক্ষ ভোটে জাতীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের পাল্লায় পিছিয়ে যাচ্ছেন নারীরা।
গত কয়েক দশকে নারী ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেকটাই। সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদেও সংসদ নেতা, স্পিকার, বিরোধী দলীয় নেতার মতো গুরুত্বপূর্ণ সব পদেই ছিলেন নারীরা। শুধু তাই নয়, স্থানীয় সরকারেও প্রায় সাড়ে ১২ হাজার নারী রয়েছেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত। কিন্তু জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়নে শেষ পর্যন্ত পুরুষদেরই প্রাধান্য দেখা গেছে।
এদিকে, নারী অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন থেকেই দাবি করে আসছেন, সংরক্ষিত আসনের বিধি সংশোধন করে সংসদে এক-তৃতীয়াংশ আসনে নারীদের প্রত্যক্ষ ভোটে জিতে আসার সুযোগ দিতে হবে। তবে নবম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে ৫০-এ উন্নীত করার পাশাপাশি সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখার বিল পাস হয়েছে। ফলে এখানেও নারীরা প্রত্যক্ষ ভোটে অংশ নিয়ে সংসদে নিজেদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার সুযোগ হারিয়েছেন।
সরাসারি ভোটে নারীদের সংসদে উপস্থিতির দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। সংগঠনটির সভাপতি আয়েশা খানম সারাবাংলাকে বলেন, ২০০৯ সালের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছিলেন, সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ১০০ করা হবে। তারা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হবেন। ২০০৮ সালে তাদের নির্বাচনি ইশতেহারেও সেই প্রতিশ্রুতি ছিল। নির্বাচিত নেতারা তাদের প্রতিশ্রুতি না রাখলে সেটা এক ধরনের প্রতারণা। আর আসন জয়ের সমীকরণ নারীদের পিছিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
আয়েশা খানম বলেন, নারীর সংখ্যাগত উন্নয়নের চেয়ে নারীর রাজনৈতিক অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। প্রতীকী অংশগ্রহণ থেকে বের হয়ে সত্যিকার অংশগ্রহণের বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামালও মনে করেন, সংরক্ষিত নয়, বরং সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে নারীদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য ফজিলাতুন্নেছা বাপ্পী সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নারীবান্ধব দল। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে সব স্তরে নারী নেতৃত্ব ৩৩ শতাংশ নিয়ে আসার নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীর অনেক দেশের সংসদে নারীর উপস্থিতি শূন্য এবং অনেক জায়গায় খুব বেশি না মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিশ্বে মোট সংসদ সদস্যের মধ্যে ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ নারী। সেই হিসেবে বাংলাদেশে দশম ও নবম জাতীয় সংসদের ২২ শতাংশের বেশি ছিল নারী নেতৃত্ব। তবে পরিসংখ্যানে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য ৩৩ শতাংশও নয়, নারীদের উপস্থিতি আরও বাড়ানোটাই আমাদের লক্ষ্য।
বাপ্পী আরও বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৮১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নারীদের উপস্থিতি ১৬ থেকে ১৮ শতাংশ। জাতীয় নির্বাচনে আরও বেশি নারীরা নেতৃত্বে আসবেন, একজন নারী হিসেবে সেটা আমিও চাই। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, জাতীয় নির্বাচন একটি প্রতিযোগিতার জায়গা। এই প্রতিযোগিতায় যেমন রাজনৈতিক দলগুলো নারীবান্ধব দিকটি বিবেচনা করবে, একইভাবে কোন প্রার্থী ‘উইনেবল’, কাকে মনোনয়ন দিলে সে দলকে জিতিয়ে নিয়ে আসতে পারবে— এসব বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। নারীকে সব জায়গায় আনুকূল্য নয়, প্রতিযোগিতা করে আসতে হবে। কিন্তু সেখানেও নারীর কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়ে গিয়েছে। এটা কেবল বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীজুড়েই সে চিত্র রয়েছে।
জাতীয় নির্বাচনে পুরুষ প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া হয় বলে তৃণমূল পর্যায়ে অনেক নারীরই অভিযোগ রয়েছে— সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এই সংসদ সদস্য বলেন, নিজেকে তৈরি করবার বিষয়টিও রয়েছে এখানে। একজন সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য প্রার্থিতা করতে গেলে তাকে অনেক গুণাবলী অর্জন করতে হবে। তাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে হবে, নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে। কারও মুখাপেক্ষী হয়ে নেতৃত্ব দেওয়া যায় না— এটা নারীকে মনে রাখতে হবে। রাজনীতি মূলত তৃণমূল ও মাঠের জায়গা। এ কথাটা মনে রেখে নারীকে তৈরি হতে।
বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবির সারাবাংলাকে বলেন, নির্বাচন এলেই আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা শুনি। এই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য নয়, নারী-পুরুষের জন্যও প্রযোজন্য। কিন্তু বাংলাদেশে নারীর জন্য সমান সুযোগ নেই। তারা মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে সমান অধিকার পান না। এখানে অনেক হিসাব-নিকাশ কাজ করে।
দুই দশক ধরে রাজনীতি করে আসছেন জাতীয় পার্টির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক অনন্যা হোসেন মৌসুমী। তিনি নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, নারায়ণগঞ্জের উপজেলা নির্বাচনে জিতে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৩ আসন থেকে মনোনয়ন চাইলে তার মেয়ে পরিচয় নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন।
মৌসুমী বলেন, নির্বাচন করতে নাকি অনেক টাকা লাগে। কিন্তু নির্বাচনে টাকার থেকে বেশি তো প্রয়োজন জনপ্রিয়তা, যা অনেক নারীরই আছে। কিন্তু তারপরও তাদের হিসাবের কথা বলে পিছিয়ে রাখা হয়।
রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিভঙ্গিতে রক্ষণশীলতা দৃশ্যমান উল্লেখ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান সারাবাংলাকে বলেন, নারীরা রাজনীতিতে এলে তাদের অবহেলার চোখে দেখা হয়। নারীদের সব ক্ষেত্রেই অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়। কোনো বড় পদে নারীদের রাখা হয় না। কিন্তু এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। কারণ, নারীরা যেকোনো পদে পুরুষের তুলনায় বেশি আন্তরিকতা, দক্ষতা এবং মনোযোগ নিয়ে কাজ করেন— সেটা প্রমাণিত। যেকোনো দায়িত্বে নারীরা সফল— এটা বোঝানোর সময় এসেছে।
সারাবাংলা/জেএ/টিআর