Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হারিয়ে যাওয়া বাংলার গান ‘অষ্টক’


২৮ নভেম্বর ২০১৮ ১৫:২৭

শেখ সাদী ।।

তখন বড়জোড় বারো বছর।

অ-এ অজগরটি ওই আসছে তেড়ে পড়া শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে।

এবার অজগর সাপ তেড়ে না এলেও ভয় তেড়ে এসেছিল আমাদের শান্ত গ্রামে। খরায় চৌচির হয়ে যায় ফসলের মাঠ। এদিকে বীজ বোনার মৌসুম গড়িয়ে যাচ্ছে; অথচ মেঘের মুখ দেখা যাচ্ছে না। খরায় হেঁচকি তোলা মাঠে হারিয়ে যাচ্ছে সবুজের চিহ্ন।
এভাবে চললে না খেয়ে মরতে হবে। বড়দের কথাগুলি আমার কানে ঢুকে পড়েছে। এখন সবার বৃষ্টির জন্য আবেদনের আয়োজন।
ভ্যাপসা গরমের দিন শেষে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামতে শুরু করেছে।
মেঘহীন আকাশে মুখ বের করে হাসছে আদখানা চাঁদ। চাঁদের আলোকে টেক্কা দিয়ে জ্বলে উঠলো হ্যাজাক। আমাদের পাশের গ্রাম হরিরামপুরে শুরু হলো অষ্টকের গান।
মঞ্চ হয়নি। আসলে অষ্টক গানে মঞ্চ দরকার হয় না। বাড়ির আঙ্গিনায় বাজনায় চারপাশ থেকে লোকেরা এসে ভিড় করেছে। অষ্টক গান শুনতে গেছি দাদার সঙ্গে।
সেদিন হয়েছিল হরগৌরী অষ্টক। উজ্জ্বল স্মৃতিতে ধরা আছে সেসব। প্রথমে শিব নন্দীভৃঙ্গিসহ নাচানাচি করে। এর কিছুক্ষণ পর দলে ভিড়লেন বিবেক। গানের সুরে শিবের কাছে আবেদন জানায় বৃষ্টির, ভিজিয়ে দাও ফসলের মাঠ, আমরা যে শুকিয়ে মরছি।
কিছুক্ষণ পর দৃশ্যের বদল।
আবার নাচগান।
এভাবে কিছু সময় পর হলে ফিরে আসে বিবেক।
শিবকে বলে, বৃষ্টি দিচ্ছ না কেন? ঠিক আছে এবার একা না, দল বেঁধে আসবো। বৃষ্টি ছাড়া তোমাকে ছাড়বো না। গানে কথায় বৃষ্টির প্রার্থনায় সেদিন রাতে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়ে চমকে দিয়েছিল কিশোর মন। আসলেই কী গানের কথা উপরে উঠে যায়? বিজ্ঞান তো অন্যকথা বলে; তবে গ্রামের সাদামাটা মানুষ এখনও বিশ্বাস করেন অষ্টক গানে বৃষ্টি নামে।

অষ্টক গানের দৃশ্য

২.
কৃষক সমাজের নিজের গান হয়ে চৈত্র মাসজুড়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় অষ্টকের দল।
লোকনৃত্যগীত অষ্টক বা অষ্টগান। কেবল গান নয় গানের সাথে চলে নাচ।
একই সাথে অনেক পালায় থাকে অভিনয়। এজন্য লোকনাট্যের পরিচয় আছে অষ্টকের চেহারায়। অনেক দলে যারা নাচে তারা গান করে না। পাশে বসে কয়েকজন গান ধরে।
একসময় দেশের প্রায় সবখানে অষ্টকের চল ছিল, বিশেষ করে চড়ক পূজার সময়।
বসন্তকালীন উৎসব, চৈত্র সংক্রান্তির বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে বসতো আসর।
অষ্টক কেবল গান নয় শিক্ষার অংশ। অষ্টাদশ শতকের অন্যতম মান্য কবি ভারতচন্দ্র রায়গুনাকর ছিলেন কৃষ্ণনগর রাজসভার সভাকবি। যাঁর জন্ম ১৭১০ সালে। মৃত্যুর বছর ১৭৮২। ভরতচন্দ্র রচিত অষ্টক নাগাষ্টক ও গঙ্গাষ্টক খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।
অষ্টকের পালাগুলি খুব একটা বড় হয় না।
ছোট ছোট গানের মধ্য দিয়ে কাহিনি তুলে ধরা হয়। কথা ও সুরে ভরপুর বৈচিত্র। দীর্ঘ টানা সুরে ভাটিয়ালি ও কীর্তনের প্রভাব চোখে পড়ার মত। সম্ভবত বসন্তকালীন উৎসব বলে অষ্টকের সুর বাঁধা হয়েছে পঞ্চমে।
কেউ কেউ কৃষ্ণলীলা কীর্তনের সাথে মিলিয়ে ফেলেন। না কোন মিল নেই।
কৃষ্ণলীলা বা গৌরলীলা ধর্মের গান। অষ্টকে বলা হয় হলো লোকায়ত জীবনের কথা বলে।

বিজ্ঞাপন

নীলপূজার গাজন উপলক্ষ্যে অষ্টকের খুব চল ছিল। গানে শিব এবং কৃষ্ণের প্রসঙ্গ এবং কথায় কৃষ্ণলীলা ও চৈতন্যের সন্ন্যাস। রাধা কৃষ্ণের প্রেম এবং বর্তমানের কোন ঘটনা। অষ্টক শব্দের মানের সঙ্গে এই গানের কোনো মিল নেই।
একদল বলেন অষ্টক আট দিনের গান। মঙ্গলবারে শুরু হয় পরের মঙ্গলবারে শেষ। যদিও অভিধানে এর কোনো মানে নেই।অষ্টক বলতে সাদামাটাভাবে বোঝায় আট অধ্যায় বা পরিচ্ছদের সমষ্টি। যদিও অষ্টকে আট বিষয়ের কোনো কিছু নেই।
‘অষ্ট’ মানে শিব। তাহলে তো অষ্টকের নাম শিবের গান হওয়া দরকার ছিল, হয়নি।
একেবারে গোড়ার দিকে অষ্টক কি সেটাই ছিল?
একথা জানা যায় না।
ঋগবেদের একটি সূক্তের নাম অষ্টক। তাহলে কি বলতে পারি এই সূক্তের সুরে অষ্টকের জন্ম হয়েছিল? এটাও স্পষ্ট নয়। আগের দিনে চৈত্র সংক্রান্তিতে নীল গাজন উপলক্ষে তিন দিন ধরে চলতো অষ্টকের আসর। গানে
বৈষ্ণবধর্মের বেশ প্রভাব। বিশেষকরে রাধাকৃষ্ণের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি।

কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা, নিমাই সন্ন্যাস নিয়ে অষ্টক গান হওয়ার কথা শোনা যায়। গাজনের এবং সামাজিক আচার-আচরণের নানা বিষয় নিয়ে অষ্টক গান হওয়ার কথা শোনা যায়। বেশিরভাগ অষ্টক রচিত হয়েছে পুরাণ, রামায়ন এবং মহাভারতকে কেন্দ্র করে। পৌরাণিক কাহিনীগুলোর পাশাপাশি সমাজ সংসারের অনেক ঘটনা উঠে এসেছে গানে।
অষ্টক সম্পর্কে একদলের ভিন্নমত কানে আসে।
বলেন, রাধা ও কৃষ্ণের আটজন সখির নাচ গানই হলো অষ্টক।
এই আট সখী- ললিতা, বিশাখা, বাসুদেবী, সুদেবী, সুচিত্রা, ইন্দুরেখা, তুঙ্গবিদ্যা ও চম্পকলতা। তাদের এই মতের পেছনে অষ্টকে কোনো কিছু পাওয়া যায়নি।

গানের মূল গায়ক গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জোগাড় করে গানের দল গঠন করতেন। তারপর চলত তাদের উপযুক্ত দীক্ষা। একসময় সকলে অষ্টক গান শিখে ফেলত; এবং তাদেরই নিয়ে গ্রামে গ্রামে অষ্টক গান করে বেড়াতেন দলের প্রধান।
এরা নানা রকম পালা করতেন। কয়েকটি পালার খবর জানা যায়, অভিমন্যু বধ, নিমাই সন্ন্যাস, চন্ডীদাস রজকিনী, শ্মশান মিলন, জেলের মেয়ে মৎস্যগন্ধা, এসব। আদিবাসী ধরনের নাচ থাকে অষ্টকে। একজন আরেকজনের কোমর ধরে একবার এগিয়ে, এবার পিছিয়ে যায়। অন্য হাতে থাকে রঙিন রুমাল। কম বয়সের ছেলেদের মুখে পাউডার দিয়ে নারী সাজানো হয়। অন্যদের মুখে পাউডার, চোখে কাজল আর দুই হাত রাঙানো হয় আলতায়।
বাদ্যযন্ত্র লাগে হারমনিয়াম, ঢোল, বেহালা, বাঁশি, জুড়ি। যতদূর জানা যায় আগের দিনে ঢাক, জুড়ি, কাঁসি ছিল অষ্টকের প্রধান বাজনা। গান শেষে এলাকার স্বচ্ছল কেউ চিঁড়ে মুড়ি গুড় দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করে। অনেকে চাল সবজিও দিত।
বর্তমানে কোন কোন এলাকা পালাগানের চরিত্রে হয় অষ্টক। যাত্রার মত ঝলমলে পোশাক। অভিনয়, গানে বাজে ড্রামসহ উচ্চ শব্দের আধুনিক বাদ্যযন্ত্র।

বিজ্ঞাপন

অষ্টক গান এরকম।

‘শিব বলে সুন্দরী, তুই তো রড় রূপসী
আমি একটু হইছি বুড়ো, তাতে ক্ষতি কী?
আমি দেব সোনার মুকুট মাথায়
সোনার মল গড়ে দিব পায়।
দুই হাতে কঙ্কন দিব
যাতে তোর শোভা হয়।
চিরুনে চুড়িয়া চুল
খোঁপায় দিয়া, হা রে চম্পা ফুল।
ফুলের গন্ধে কেড়ে নেয়
প্রাণের যুবতীর কুল।
(সংগৃহিত)

সারাবাংলা/পিএম

অষ্টক গান শেখ সাদী

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর