মনোনয়ন পাননি, তবুও ‘বিদ্রোহী’ নন তারা
৩০ নভেম্বর ২০১৮ ০৯:৪৭
।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম মহানগর ও আশপাশের এলাকার আসনগুলোতে যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন, তাদের পাশে এখনও দেখা যাচ্ছে না মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের। এসব মনোনয়ন প্রত্যাশীকে কাছে টানার দৃশ্যমান কোন উদ্যোগও নেননি প্রার্থীরা। তবে মনোনয়ন না পাওয়া নেতারা বলেছেন, দলের বিরুদ্ধে কোন অবস্থান তারা নেবেন না। বরং তারা নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর পক্ষে মাঠে থাকবেন।
চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) ও চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালী-বাকলিয়া) আসনে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন পেয়েছেন জাসদ একাংশের নেতা মঈনউদ্দিন খান বাদল এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।
দুই আসনে মনোনয়নের দাবীদার ছিলেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং অর্থ সম্পাদক মো.আবদুচ ছালাম। প্রবীণ নেতা বিএসসি বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছালাম চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
‘নৌকাকে জেতাতে হবে, এটাই এখন আমার একমাত্র দায়িত্ব’
বাদল ও নওফেল মনোনয়ন পত্র দাখিলের সময় নগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ প্রায় সব নেতা থাকলেও পাশে দেখা যায়নি বিএসসি ও ছালামকে। মন্ত্রী হওয়ায় আচরণ বিধির বাধ্যবাধকতার কারণে যাননি বিএসসি। আর ছালাম জানিয়েছেন, তিনি সিডিএ’র একটি উন্নয়ন কাজ নিয়ে বাকলিয়া এক্সেস রোডে ব্যস্ত ছিলেন।
নুরুল ইসলাম বিএসসি সারাবাংলাকে বলেন, ‘নৌকা মার্কায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকেই প্রার্থী করেছেন, আমি তার পাশে আছি। নৌকাকে জেতাতে যা করতে হয় সবই করব।’
নুরুল ইসলাম বিএসসি ১৯৯১ এবং ১৯৯৬ সালে বোয়ালখালী আসন থেকে নির্বাচন করে হেরেছিলেন। ২০০৮ সালে কোতোয়ালী-বাকলিয়া আসন থেকে নির্বাচন করে জিতেছিলেন। ২০১৪ সালে আসনটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়ায় মনোনয়ন বঞ্চিত হন বিএসসি। পরে তাকে শেখ হাসিনা মন্ত্রীসভায় নেন।
আবদুচ ছালাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা প্রার্থী হয়েছেন, তাদের মনোনয়ন দিয়েছে আমার দল আওয়ামী লীগ এবং আমার নেত্রী শেখ হাসিনা। দল ও নেত্রীর প্রতি অসম্মান দেখানোর কোন সুযোগ নেই। মনোনয়ন পেলাম কি পেলাম না, এটা নিয়ে আমি চিন্তিত নই। নৌকাকে জেতাতে হবে, এটাই এখন আমার একমাত্র দায়িত্ব।’
বুধবার রাতে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের বাসায় নওফেলের নির্বাচন প্রস্তুতি বৈঠকে গিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করে এসেছেন বলেও জানান ছালাম। আগের দিন অবশ্য নির্বাচন উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ডাকা বর্ধিত সভায় যাননি ছালাম।
দলীয় মনোনয়ন নিয়ে চট্টগ্রামে এসে বাদল ও নওফেল নগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের কাছে যান। এছাড়া নওফেল ব্যক্তিগতভাবে অন্যান্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেন। এজন্য শুরু থেকে নওফেলের পাশে আছেন চট্টগ্রাম-৯ আসনে আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী, কোতোয়ালী থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান মনসুর।
কোন অভিমান কিংবা কষ্টবোধ নেই
চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর) আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন আগের দু’বারের সংসদ সদস্য ডা.আফছারুল আমিন। এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু ও যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ।
বাচ্চু-ফরিদের ঘনিষ্ঠজনদের সূত্রে জানা গেছে, আফছারুল আমিন দলীয় মনোনয়ন পেলেও যুবলীগের এই দুজন মনোনয়ন প্রত্যাশীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এমনকি মনোনয়ন পত্র দাখিলের সময়ও তাদের সঙ্গে নেননি আফসারুল আমিন। এজন্য মনোনয়ন পত্র দাখিলের সময় আফসারুল আমিনের সঙ্গে নিজ সংসদীয় আসনের উল্লেখযোগ্য কোন নেতাকে দেখা যায়নি। লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ‘বিতর্কিত’ নেতা দিদারুল আলম মাসুমকে সঙ্গে নিয়ে বরং সমালোচনার মুখে পড়েছেন আফসারুল আমিন।
এই বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য বেশ কয়েকবার ডা.আফসারুল আমিনকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে মহিউদ্দিন বাচ্চু এবং ফরিদ মাহমুদ উভয়ই জানিয়েছেন, মনোনয়ন না পাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে কোন অভিমান কিংবা কষ্টবোধ নেই।
মহিউদ্দিন বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই নিয়ে দ্বিতীয়বার মনোনয়ন চেয়ে আমি পাইনি। তারপরও আমার মধ্যে কোন কষ্ট নেই। জননেত্রী শেখ হাসিনা যাকে প্রার্থী করেছেন, তিনিই আমাদের প্রার্থী। যতটুকু সাধ্য আছে, সবটুকু নিয়ে নৌকার প্রার্থীদের পাশে থাকব। এটা দলের প্রয়োজন এবং দেশের প্রয়োজন।’
ফরিদ মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের আদর্শ মেনে রাজনীতি করছি। আদর্শ এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি শতভাগ আনুগত্য রেখেই রাজনীতি করি। মনোনয়ন পাইনি বলে অভিমান করে ঘরে বসে থাকব, সেই ধরনের রাজনীতি আমি করি না। নেত্রী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অবশ্যই কাজ করব।’
জনগণ থেকে আমাকে দূরে রাখার সাধ্য কারো নাই
চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর) আসনে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে জোর খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত মনোনয়ন বাগিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে গত তিন বছর ধরে কোণঠাসা হয়ে থাকা এম এ লতিফ।
সুজনের ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন, মনোনয়ন পেয়ে সৌজন্যতাবশত সুজনের সহযোগিতাও চাননি লতিফ। এমনকি মনোনয়ন পত্র দাখিলের সময়ও সঙ্গে নেননি।
খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, আমার রাজনীতির বীজ বপন হয়েছে দেশপ্রেম থেকে, আদর্শ থেকে, মুক্তিযুদ্ধের অবিনাশী চেতনা থেকে। ষড়যন্ত্র করে, চক্রান্ত করে আমাকে মনোনয়ন থেকে দুরে রাখলেও রাজনীতি থেকে, জনগণ থেকে আমাকে দূরে রাখার সাধ্য কারো নাই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে আদর্শ, সে আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য আগামী নির্বাচনে নৌকা মার্কার পক্ষে আমি সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখব।
জীবন বাজি রেখে সব প্রার্থীকে জিতিয়ে আনব
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড ও সিটি করপোরেশনের একাংশ) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন গতবারের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম। এর বিরোধিতা করে সীতাকুণ্ড উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম আল মামুন স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিলেও পরে তিনি সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। তবে ওই আসনে এখনও স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়ে গেছেন একজন। তিনি হলেন সীতাকুণ্ড উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়া।
এর আগে নগর আওয়ামী লীগের সর্বশেষ বর্ধিত সভায় মেয়র দলীয় প্রার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনাদের মধ্যে নেতাকর্মীদের সবাইকে নিয়ে কাজ করবেন, এই মনোভাব থাকতে হবে। তাহলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে উৎসাহিত হবেন। বিজয়ের ভাগিদার সবাই হতে চায়। কিন্তু ব্যর্থতার ভাগ কেউ নিতে চায় না। মনের কথা বলছি। আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হতে চাই না, সম্মান ও মর্যাদা চাই। জীবন বাজি রেখে সব প্রার্থীকে জিতিয়ে আনব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নগর আওয়ামী লীগের একজন সহ-সভাপতি ও দুজন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সারাবাংলাকে বলেন, ‘যারা মনোনয়ন পাননি এবং যেসব নেতাদের সঙ্গে দূরত্ব আছে তাদের কাছে ডেকে নেওয়ার ইঙ্গিত ছিল মেয়রের এই বক্তব্যে। কিন্তু মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং মঈনউদ্দিন খান বাদল ছাড়া বাকি দুজন প্রার্থীকে এখনও শুধু নিজেদের অনুসারীদের নিয়েই চলতে দেখা যাচ্ছে। সব মনোনয়ন প্রত্যাশীসহ সকল নেতাকর্মীদের কাছে ডেকে যদি একসাথে চলতে না পারেন, তাহলে বিজয় কঠিন হবে।’
সারাবাংলা/আরডি/ আরএ