কমিশনার তার অফিসে আটকে রেখে বলেছে, ‘তোরে জ্বালায়ে দেব’
২ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৯:০৯
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: কত নির্যাতন, কত বৈষম্য, কত অপমান সহ্য করেছি। আমাকে মারতে ছিল, সেই মার ঠেকাতে গিয়ে আমার স্ত্রী পর্যন্ত ওদের হাতে মার খেয়েছে। প্রথম দিকে যখন ঘটনাটা জানল সবাই তখন এলাকার কমিনশনার অফিসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসায়ে রাখছে। কমিশনার বলছে, ‘সরকার বলছে এই রোগীদের জ্বালাইয়ে দেওয়ার জন্য।’ সে বলছে, ‘এখনি জ্বালায়ে দিমু তোরে’, তাও শুনছি, কিন্তু কিচ্ছু করার ছিল না-কথাগুলো বলছিলেন সিরাজুল ইসলাম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচআইভি সেন্টারে তার কথা হচ্ছিল। সে কক্ষে মাথার ওপর ফুল স্পিডে ফ্যান চলছিল। কিন্তু কথা বলতে বলতে ঘামছিলেন সিরাজুল। এক হাতে টিস্যু দিয়ে ঘাম মোছেন আর কথা বলেন তিনি।
কিন্তু সিরাজুল একসময় থেমে যান, কেঁদে দেন তিনি। বলেন, নিজের গ্রামে নিজের একখণ্ড জমির ওপর ঘর তুলে থাকেন, তারপরও সমাজ তাকে নেয় না, সমাজের কিছুতেই তিনিসহ তার পরিবারের কোনো অংশগ্রহণ নেই। ছেলে-মেয়েকে মানুষ কথা শোনায়, নিন্দা করে। বলেন, যদি নিজের বাড়ি না হতো তাহলে তাকে অনেক আগেই গ্রামছাড়া করা হতো।
৪১ বছরের সিরাজুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। ঢাকার পাশেই একটি জেলায় অটোগাড়ি চালান ( নিরাপত্তা এবং সামাজিকতার স্বার্থে তার আসল নাম এবং ঠিকানা গোপন রাখা হলো)। ২০১৩ সালে ঘাড়ের পেছনে টিউমার হওয়াতে এলাকার স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হন। অস্ত্রোপচার করার আগে রক্ত পরীক্ষা হয়। কিন্তু সে পরীক্ষার রির্পোট আসার পর আর চিকিৎসা হয় না তার।
সিরাজুলের ভাষায়, ‘তারা কিছু বলেও না, অপারেশনও করে না। তারা স্পষ্ট করে বলেও না কী হয়েছে, কেবল বললো-এখানে আপনার অপারেশন হবে না, কিছুতেই সম্ভব না’। আমি তখনও জানি না, আমার কী হইছে। আমাকে বলল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে, যখন এই হাসপাতাল রিলিজ করলো সেখানে তারা কেবল লিখছে রিঅ্যাকটিভ। ঢাকা মেডিকেলে আসার পর তারা রিঅ্যাকটিভ দেখে বলছে, এই চিকিৎসা এখানে হয় না, অন্য জায়গায় যান’।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ি চলে যান তিনি। জানালেন, চিকিৎসাপত্র গোপন রেখে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে যান চিকিৎসার জন্য। ‘তখন আমাদের একটাই চিন্তা-কারণ কী, কেন আমাকে কোথাও ভর্তি রাখে না, কেন আমার অপারেশন করতে চায় না হাসপাতাল’ বলেন সিরাজুল। ‘অনেক কষ্ট হইছে, অনেক জায়গায় দৌড়াইছি যেখানেই কাগজপত্র দেই, সেখানেই কেমন করে তাকায়ে কাগজপত্র ফেরত দেয়, আমাকে ভর্তি নেয় না, আমাদের বাইর কইরা দেয়, কেমন অন্য চোখে দেখে’-যোগ করেন তিনি।
সেখান থেকে মহাখালীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে যান। ‘সেইখানেও চেষ্টা কইরা ভর্তি হইতে পারলাম না, ব্যর্থ হইলাম’, বলেন তিনি।
ততদিন সিরাজুলের ঘাড়ের পেছনের টিউমার অনেক বড় হয়ে গেছে, সেটি পেকে গিয়ে পুঁজ বের হচ্ছে। অপারেশন না করতে পারলে আরও সমস্যা হবে বুঝতেছিলেন তিনি কিন্তু কোথাও ভর্তি হতেই পারছিলেন না। তারপর বেসরকারি এক ক্লিনিকে একজন সার্জনের সাথে যোগাযোগ করেন আগের সব প্রেসক্রিপশন ছাড়া। সিরাজুলের ভাষায়- বিষয়টা এমন, আমি ওই টিউমারের জন্যই গেছি। সেখানে টিউমারের অপারেশন হলো।
এরপর কারও একজনের পরামর্শে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আশার আলোতে যান সিরাজুল। যারা এইচআইভি পজিটিভ মানুষদের নিয়ে কাজ করেন। সেখানেই প্রথম সিরাজুল জানতে পারেন-তিনি এইচআইভি পজিটিভ।
সিরাজুল বলেন, ‘আশার আলোতে যাওয়ার পর জানতে পারলাম, আমি একজন এইডস রোগী, এইচআইভি পজিটিভ। এটা ধরা পড়ার পর আমি খুব ভেঙে পড়েছিলাম, ওষুধ খামুই না, মইরা যাইমু।
কিন্তু আশার আলোর ‘বড় ডাক্তার নীলুফার আপা’-সে আমাকে অনেক বুঝাইছে। অনেক সময় দিতো ডাক্তার আপা আমাকে, বুঝাতো-তোমার জন্য না হোক, ছেলে-মেয়ের জন্য বাঁচতে হবে। আর ওষুধ খেলে মানুষ বেঁচে থাকে। কিন্তু আমার কথা ছিল, আমি তো কখনো ‘খারাপ কাজ’ করি নাই, তাহলে আমার কেন এইডস হবে?
আশার আলোতে গিয়েই জানতে পারলাম, কেবল যৌন সংসর্গ না, অনিরাপদ রক্ত নিলে সেখান থেকেও মানুষ এইচআইভি পজিটিভ হতে পারে।
কিন্তু এর আগে কেউ আমাকে বলেই নাই আমার কী রোগ, চিকিৎসাও দেয় নাই-আমি তো কিছুই জানতাম না। আশার আলো আমাকে সদস্য হিসেবে নিল-সেই ২০১৩ সাল থেকে ওষুধ খাইতাছি, আমি ভালো আছি’।
বাবা নেই। সংসার মা, স্ত্রী আর এক ছেলে এক মেয়ে আছেন। মাকেও জানাননি তিনি এই অসুখের কথা। স্ত্রী আর ছেলে মেয়ে জানেন। ‘তারা কেউ ঘৃণার চোখে দেখে না। কিন্তু পাড়া প্রতিবেশী যারা রয়েছে তারা ঘৃণা করে। নিজের বাড়িতে থাকি, কিন্তু সমাজ আমাকে নেয় না, প্রায় এক ঘরে করে রাখে। কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই। ছেলে-মেয়েকে অনেকেই নিন্দার চোখে দেখে, সমাজ নাম নেয় না। এমন অবস্থায় আছি-কারও কাছে প্রকাশও করতে পারি না’-চোখ মোছেন আর কথা বলেন সিরাজুল।
কোথা থেকে এইচআইভি সংক্রমণ হলো নিজেও জানেন না তিনি। কেবল বললেন, ‘একটা বিষয় আমার মনে হয়-যখন গার্মেন্টেসে কাজ করতাম তখন একবার মেশিনের নিচে হাত গিয়ে আঙুল কেটে গিয়েছিল। তখন রক্ত দিতে হইছিল অনেক । আমার মনে হয়- সেখান থেকে হতে পারে। আবার গ্রামে কিছু হলে এক ‘সুঁই’ দিয়ে অনেককে ইনজেকশন দিতো-তখনতো এত সচেতনতা ছিল না, বুঝতামও না। সেখান থেকেও হতে পারে।
এগুলো জানতে পেরেছি আশার আলোতে গিয়ে, সেখানে বলতো-কারও এইডস হলে কেবল ‘খারাপ দিক’টাই দেইখেন না, অনেকভাবেই অনেকে এইচআইভি পজিটিভ হতে পারেন-কিন্তু মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্র এটা দেখে না। সবাই ভাবে কেবল ‘খারাপ কাজ’ করলেই এইডসের রোগী হয়–এইটা আমাদের জন্য কতোটা কষ্টের সেটা আমরাই জানি। আর কেউ বুঝবে না।’
বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। প্রতিমাসে একবার করে আসতে হয় এখানে।
সিরাজুল কথা বলেন আর কাঁদেন। তবে একসময় নিজেকে সামলে নেন। বলেন-সে সময় কতোবার আত্মহত্যা করতে চাইছি, কিন্তু আমার স্ত্রী সহযোগিতা করত। তার সহযোগিতা ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারতাম না। আমি তো মরে যেতে চাইতাম- সে আমাকে পাহারা দিয়ে রাখত, সবসময় চোখে চোখে রাখত, আমি এই মানুষটার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।
সারাবাংলা/জেএ/একে