‘শিক্ষার্থীদের মানসিকতা আমরা বুঝছি না’
৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ২০:১১
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সারাবিশ্বে পৃথিবীতে আত্মহত্যাপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যানে এই তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন আরও বলছে, বিশ্বে যত মানুষ আত্মহত্যা করেন, তার মধ্যে ২ দশমিক ০৬ শতাংশ বাংলাদেশি। সেই হিসাবে বাংলাদেশে বছরে প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যা করেন। আর এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
এদিকে, পুলিশ সদর দফতর ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করেন। অর্থাৎ প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। এর মধ্যে আবার বড় একটি অংশ রয়েছে প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত স্তরে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারীর (১৫) আত্মহত্যার ঘটনা আরও একবার নাড়া দিয়ে গেল গোটা সমাজকে।
মঙ্গলবার (৪ ডিসেম্বর) শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ অরিত্রীর স্কুলে যান। সেখানে তখন এই হত্যার বিচার চেয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের বিক্ষোভ চলছিল। তাদের উদ্দেশে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘একজন শিক্ষার্থী কতটা অপমানিত হলে, কতটা কষ্ট পেলে আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেয়? যে ঘটনাগুলো আমরা শুনছি, এর পেছনের কথা শুনছি। ঘটনার পেছনে বা ঘটনার সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক, প্রমাণ পাওয়া গেলে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সোমবারের এই আত্মহত্যার ঘটনায় এখন পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুইটি ও স্কুল কর্তৃপক্ষের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আত্মহত্যার কারণ জানতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে স্বপ্রণোদিত রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
স্কুলে মোবাইলে নকল করার অভিযোগে অরিত্রীকে পরীক্ষা দিতে না দেওয়া, মা-বাবাকে স্কুলে তলব, তাকে স্কুল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত এবং সব শেষ গতকাল অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যা— এত ঘটনা ছাপিয়ে এখন সামনে চলে এসেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অব্যবস্থাপনা।
ঘটনা সূত্রে আরও একবার সামনে চলে আসে গত জুলাইয়ে সুমাইয়া আক্তার মালিহার আত্মহত্যার ঘটনা। মাত্র ১৪ বছর বয়সী মালিহা তার সুইসাইড নোটে লিখেছিল, ‘আমার Suicide করার কারণ একমাত্র রিমি মেডাম। সে শুধু আমাকে দেখে তার জিদ কমানোর জন্য। সে অযথা পরীক্ষায় আমার খাতা নিসে। আর পরীক্ষায় কম নাম্বার দিসে। তোমরা যদি পার তাহলে সে মেডামের মানসিক চিকিৎসা দাও। Mental Hospital এ পাঠাও। মেডাম আমারে অভিশাপ দিসে, তাই আমি ভালো result খারাপ হইছে। Maliha’
গত ২৪ জুলাই রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় গুলবাগের বাসা থেকে পুলিশ মালিহার মৃতদেহ উদ্ধার করে।
অরিত্রী অধিকারী বা সুমাইয়া আক্তার মালিহার মৃত্যুকে নিছক ‘আত্মহত্যা’ বলতে রাজি নন অনেকেই। আত্মহত্যায় প্ররোচণার অভিযোগও উঠেছে জোরালোভাবে। অভিভাবকরা বলছেন, দ্য এডুকেটর শ্যুড বি এডুকেটেড ফার্স্ট।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু সচেতনতাই পারে এমন মৃত্যু রোধ করতে। শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা না বোঝা, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না থাকা, শিক্ষকদের অপমানজনক আচরণ ও হেনস্তা, লেখাপড়ার অতিরিক্ত চাপ— এসব কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে।
তারা বলেন, প্রতিটি শিশুর আবেগ, আগ্রহ, সাড়া দেওয়ার প্রবণতা এবং প্রতিভা ভিন্ন হয়। সেভাবে পরিচর্যা না করে যদি সব শিশুকে এক ছাঁচে গড়ার চেষ্টা করা হয়, তাহলে শিশুর মনন ও মানসিক স্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
অন্যদিকে শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তার মূল চরিত্র হারিয়েছে এবং ফলাফল-নির্ভর কারখানায় পরিণত হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচির সমন্বয়কারী ও শিশু সংগঠক আবদুল্লা আল মামুন সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের দেশে শিক্ষা ক্রমশ ফলাফল নির্ভর বিশেষায়িত কারখানার পণ্য হয়ে উঠছে। বেশিরভাগ অভিভাবক ও শিক্ষক মিলে যেন শিক্ষা খামার থেকে ‘জিপিএ ৫’ টাইপের ফলাফল উৎপাদনের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। আর এই প্রতিযোগিতার বলির শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
আবদুল্লা আল মামুন বলেন, অধিকাংশ স্কুল শিশুদের সঙ্গে মনোসংযোগ তৈরি করতে পারছে না, বুঝতে পারছে না তাদের মানসিক চাহিদা। উল্টো শিক্ষার্থীদের সবার কাছ থেকে একই রকম ভালো ফলের জন্য অব্যাহত চাপ দেওয়া হচ্ছে। ফলে শিশুদের মধ্যে মানসিক চাপ ও হতাশা বাড়ছে। এর ফলে মাদকসহ নানা অসামাজিক কাজে এই শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে, কেউ কেউ বেছে নিচ্ছে আত্মহননের পথ।
‘শিশুদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে তাদের মতো করে। তাদের নিজস্ব ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মান ও লজ্জাবোধকে স্বীকৃতি ও অন্যান্য আবেগকে সম্মান দিতে হবে। বয়সে ছোট বলে শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব ও আবেগকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করা যাবে না। স্কুলগুলো শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য এ বিষয়ক দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি নিতে পারে। মনে রাখতে হবে, প্রতিজন শিক্ষার্থী একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ, তার আবেগ ও অনুভূতিকে যত্নের সাথে মূল্যায়ন করতে হবে। তবেই আমরা পাব মননশীল আগামী প্রজন্ম,’— বলেন মামুন।
ভিকারুননিসা স্কুলের শিক্ষার্থী অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকেই। স্বনামধন্য এমন একটি স্কুলের শিক্ষকদের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ কাম্য নয় বলেও মত দিচ্ছেন কেউ কেউ। শিক্ষাবিদরাও বলছেন, শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব বুঝেই তাদের সঙ্গে আচরণের ধরণ নির্ধারণ করতে হবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগের দিনের শিক্ষকদের মতো বকা দেওয়া বা শারীরিক নির্যাতন করার দিন আর এখন নেই। এখনকার বাচ্চারা অনেক বেশি সেনসিটিভ (সংবেদনশীল)। কারণ আধুনিক এই যুগে গোটা বিশ্বের সংস্কৃতি এখন উন্মুক্ত। ফলে এখনকার শিশুরা আরও বেশি জানছে, আরও বেশি স্বাধীনচেতা মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠছে। এমন সময়ে শিশুদের এমন কিছু শিক্ষকদের পক্ষে বলাটা ঠিক হবে না যাতে শিশুটি অপমানিত বোধ করে, সবার কাছে ছোট হয়।’ কিন্তু আমাদের কথা বলা, কাজ— সবকিছু মিলিয়ে একটি অসুস্থ পরিবেশ তৈরি হয়েছে এবং সেই অসুস্থ পরিবেশ থেকে বের না হতে পারলে ভবিষ্যতে সমস্যা আরও বাড়বে বলেও আশঙ্কা করেন তিনি।
সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি, কোচিংসহ শিশুদের ওপর ভালো ফল প্রত্যাশার নামে যে চাপ তৈরি করছে, তা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় অরাজকতা তৈরি করেছে এবং এগুলো শিশুদের মানসিকভাবে আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে বলে মনে করেন রাশেদা রওনক খান। তিনি বলেন, এত এত চাপের কারণে শিশুরা বাড়তি কিছু নিতে পারছে না। যে কারণে পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলের কারণে এখন আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছে। শিক্ষা পদ্ধতি, অভিভাবক শিক্ষক সকলের ভেতরেই অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার ফলাফলই বাচ্চাদের আত্মহত্যা।
একইসঙ্গে বর্তমানে বাচ্চাদের একা বেড়ে ওঠাও এর অন্যতম কারণ জানিয়ে রাশেদা রওনক খান বলেন, পরিবারে এখন এক অথবা দুই সন্তান থাকছে, পারিবারিক বন্ধনটাও বেশি শক্তিশালী নয়। ফলে বাচ্চাদের পারিবারিক, সামাজিক, নিজ দেশের প্রতিও কোনো বন্ধন তৈরি হচ্ছে না, একাকিত্ব তৈরি হচ্ছে। বাচ্চারা পরিবার, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে। -যার পরিণতিতে এসব আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে বলেন রাশেদা রওনক খান।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, একই ধরনের চাপের মুখে সবাই আত্মহত্যা করেন না। কারণ সবার মানসিক অবস্থা এক নয়। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা শিক্ষকদের জানা জরুরি।
স্কুলগুলোতে চাইল্ড সাইকোলজিস্ট নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি অনেক দিন ধরে বলা হলেও সে পরিমাণ চাইল্ড সাইকোলজিস্ট এখনও তৈরি হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে এখন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের আচরণ কেমন হবে, কোন শিক্ষার্থীর মানসিক শক্তি বা স্ট্যাবিলিটি কেমন, সেটা শিক্ষকদের অবশ্যই বুঝতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এই বয়সে আত্মহত্যার প্রধান কারণ, নিজেকে বা পরিবারের কাউকে নিয়ে অপমানিত বোধ করা আর সেটাই অরিত্রীর ক্ষেত্রেও হয়েছে। এ কারণে মা-বাবার অপমানিত হওয়া এবং স্কুল থেকে ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়টিও অরিত্রীকে মানসিক ট্রমার ভেতরে ফেলে দিয়েছিল।
এগুলো সহ্য করার মতো শক্ত মানসিকতা সবার থাকে না, সবাই সেভাবে তৈরি হয় না, আবার আক্ষেপ থেকেও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় বলে জানান এই চিকিৎসক। আবার যারা অপমান করে, তারা সেনসিটিভ কেন হবে না প্রশ্ন করে তাজুল ইসলাম বলেন, এর জন্য অনেকভাবেই শাস্তি দেওয়ার পথ শিক্ষক বেছে নিতে পারতেন।
তবে সন্তানদের এসব বিষয়ে অভিভাবকেও সর্তক হতে হবে জানিয়ে ডা. তাজুল বলেন, ভালো বিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়ালেখার জন্য অভিভাবকদের যে আকাঙ্ক্ষা, সেখান থেকেও বের হতে হবে। সব স্কুলেও এখন জিপিএ ফাইভ পাওয়ানোর জন্য অভিভাবকদের যে তাগিদ, সে তাগিদও সন্তানকে চাপে ফেলে। এ চাপ থেকেও শিক্ষার্থীদের মুক্ত করতে হবে বিদ্যালয়, শিক্ষক ও অভিভাবককে।
তিনি বলেন, অরিত্রীকে অবশ্যই আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা হয়েছে। এমনকি বলতে চাই, সব আত্মহত্যাই আত্মহত্যা নয়, কিছু আত্মহত্যা রীতিমতো হত্যাকাণ্ডের সামিল।
আরও পড়ুন-
ক্ষমা চাইলেন ভিকারুননিসার অধ্যক্ষ
শান্তিনগরে ভিকারুননিসা শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া হবে: শিক্ষামন্ত্রী
ভিকারুননিসার শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, তদন্তে ৩ কমিটি
ভিকারুননিসার প্রভাতী শাখার প্রধান শিক্ষক সাময়িক বরখাস্ত
শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ
বুধবার ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের
সারাবাংলা/জেএ/এটি/জেডএফ
ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভিকারুননিসা শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা