জাবি ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে এ কেমন ভুল?
৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:১৭
।। জাবি করেসপন্ডেন্ট ।।
‘আমি ২৮ নভেম্বর সকালে রেজাল্ট দেখে খুব খুশি হই। কারণ তখন প্রকাশিত ফলাফলে আমাকে ইতিহাস বিভাগ দেওয়া হয়। আমি খবরটি বাড়িতে জানাই। একই সঙ্গে অনলাইনে ভর্তি হওয়ার জন্য পরিবারকে টাকা পাঠাতে বলি। পরে রাতে দেখি দ্বিতীয়বার ফল প্রকাশিত হয়েছে এবং তাতে আমার নাম নেই। আমি খুব ভেঙে পড়ি। কারণ আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি এ খবর তখন সবাইকে জানিয়েছি। পরেরদিন মা আমাকে ফোন দিয়ে বলে, বাবা ভর্তির জন্য টাকা পাঠাবে। আমি তখন ঘটনা খুলে বলি। এতে আমার পরিবারে শোকের ছায়া নেমে আসে।’
কথাগুলো ছিল অনুপম রায় নামের এক শিক্ষার্থীর। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষ স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তিচ্ছু। গত ২৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে (ju-admission.org) প্রকাশিত কলা ও মানবিকী অনুষদভুক্ত ‘সি’ ইউনিটের চূড়ান্ত মেধা তালিকায় অনুপমকে ইতিহাস বিভাগ দেওয়া হয়। কিন্তু সেদিন দুপুরের দিকে ফলাফল তুলে দিয়ে রাতে সেই ফলাফল সংশোধন করে নতুন করে ফলাফল প্রকাশ করা হয়। প্রথমবার প্রকাশিত ফলাফলে ভর্তির জন্য যোগ্য বিবেচিত হলে নতুন করে প্রকাশিত ফলাফলে তার নাম নেই। এমন ঘটনা ঘটেছে ২৯ ভর্তিচ্ছুর ক্ষেত্রে।
অনুপম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এমন ভুল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের গাফিলতির কারণে এমনটি হয়েছে।’
গত ২৮ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে (ju-admission.org) সব অনুষদ ও ইনস্টিটিউটের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। তবে সাক্ষাৎকারের পর অন্যান্য ইউনিটে একবারই চূড়ান্ত মেধা তালিকা প্রকাশ করা হলেও ‘সি’ ইউনিটে দুইবার ভর্তির জন্য নির্বাচিত প্রার্থীদের ফল প্রকাশ করা হয়।
সকালের দিকে ‘সি’ ইউনিটের ফল প্রকাশ করে দুপুরের দিকে তা ওয়েবসাইট থেকে তুলে দেওয়া হয়। সে সময় কারণ হিসেবে বলা হয়, ফলাফলের বিভাগ ভিত্তিক আসন সংখ্যার হিসাবে গরমিল থাকায় ফল তুলে নেওয়া হয়েছে। এরপর রাতে ওই ফলাফল সংশোধন করে আবার নতুন করে প্রকাশ করা হয়। আর এই ইউনিটে প্রথমবার ও সর্বশেষ প্রকাশিত ফলাফল ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে। প্রথমবার প্রকাশিত ফলাফল থেকে ২৯ জনকে বাদ দিয়ে নতুন করে ফল প্রকাশ করা হয়। প্রথমবার প্রকাশিত ফলাফলে নাম ছিল না এমন ২৭ জনকে নতুন করে প্রকাশিত ফলাফলে যোগ করা হয়। এমন জটিলতায় ২৯ শিক্ষার্থীর স্বপ্নভঙ্গ হলেও এর দায় নিতে অস্বীকার করছে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। ফল প্রকাশ নিয়ে প্রশাসনের এমন কাণ্ডকে প্রহসন বলে উল্লেখ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্র জানায়, ‘সি’ ইউনিটের আগে প্রকাশিত তালিকায় মানবিকের ‘মেয়ে’ শাখা থেকে সুরাইয়া আক্তার রাত্রি ও দীপিকা মন্ডল; মানবিকের ‘ছেলে’ শাখায় মো. মাহাফুজ্জামান, অনুপম রায়, নাদু মিয়া ও সজল; ব্যাবসায় শিক্ষা ‘মেয়ে’ শাখায় সারাওয়াত মাহাজাবিন, তামান্না পারভীন ও বৃষ্টি সরকার এবং বিজ্ঞান ‘মেয়ে’ শাখা থেকে আসমা আক্তার, জারীন তাসনিম ও মেহজাবিন আফরোজ পরবর্তীতে প্রকাশিত মেধাতালিকায় স্থান পাননি।
একইভাবে বিজ্ঞান (ছেলে) শাখা থেকে মো. আনোয়ারুল আজিম, আজহারুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল নোমান, মো. রাফিজ খান, রেজা মো. সাজিদুল করিম শুভ, মো. সিরাজুস সালেকীন, মো. আবির ও আজমাইন আকিল আবিদকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, নতুন প্রকাশিত ফলাফলের তালিকায় ব্যবসায় শিক্ষার ‘মেয়ে’ শাখায় নাদিয়া ইসলাম, শাহরিন জাওয়া রিফাত ও মওদুনা তানজিম খানকে যোগ করা হয়েছে। এভাবে মানবিকের ‘মেয়ে’ শাখায় সুমাইয়া আক্তার ও নুসরাত জাহান অন্তরা; মানবিকের ছেলে শাখায় মো. এনায়েতুর রহমান ও মো. রুবেল মিয়া; বিজ্ঞান ‘মেয়ে’ শাখায় স্বর্ণালী আক্তার, ফাতেমা-তুজ জোহরা ও দিশা সরকার; বিজ্ঞান ‘ছেলে’ শাখায় আহমেদ তানভীর রিফাত, মো. মাসুদ রানা, জায়েদ হোসেন আলিফ, আব্দুর রহমান খান সার্জিল, মো. বিল্লাল হোসেন তুহিন, অলোক দাস ও ইমতিয়াজ ইকবালকে যোগ করা হয়েছে।
এছাড়া ‘সি’ ইউনিটে ইংরেজি বিভাগের জন্য আলাদা করে ফল প্রকাশ করা হয়েছে। এই বিভাগের আগে প্রকাশিত ফলের ‘ছেলে’ তালিকা থেকে মো. এনায়েতুর রহমান, মো. আতিক শাহরিয়ার অন্তর, শাহরিয়ার ইকবাল চৌধুরী রাজ, মো. রুবেল মিয়া, মো. সুলেমান সিদ্দিক, রিফাত আল আজাদ, সাকিন আহমেদ সিজান, রুদ্র তাপস চৌধুরী ও জুবায়ের আহমেদকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে, মো. আনোয়ারুল আজিম, আজহারুল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল নোমান, মো. রাফিজ খান, রেজা মো সাজিদুল করিম শুভ, মো. সিরাজুস সালেকীন, মো. আবির, আজমাইন আকিল আবিদ, মাহিদুল হক তানভীর ও জুবায়ের বিন আরিফকে যোগ করা হয়েছে।
মো. আনোয়ারুল আজিম নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘২৮ নভেম্বর প্রথমবার প্রকাশিত ফলাফলে তিনি ইতিহাস বিভাগ পান। অথচ নতুন প্রকাশিত ফলে তিনি ইংরেজি বিভাগ পেয়েছেন।’
কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটির সদস্য ইন্সটিটিউটঅব ইনফরমেশন টেকনোলজির পরিচালক এম মেসবাহউদ্দিন সরকার বলেন, ‘সাক্ষাৎকারের পর নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট ডিন। আর অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা টেকনোলজি কমিটি শুধু এই রেজাল্ট ওয়েবসাইটে আপলোড করে। অর্থাৎ কোনো ভুল হলে সেটার দায় টেকনোলজি কমিটির না।’
ডেপুটি রেজিস্ট্রার (শিক্ষা) ও কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব মো. আবু হাসান বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু জানিনা। এটা সংশ্লিষ্ট ডিন ভালো বলতে পারবেন।’
ফলাফলের এই তালিকায় গরমিলের ব্যাপারে কথা বলতে কলা ও মানবিকী অনুষদের ডিন মোজাম্মেল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সরাসরি দেখা করতে বলেন। এ সময় প্রশ্ন করলে তিনি মুঠোফোনে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। তবে তিনি মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। ভুল হতেই পারে, সেজন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিশ্ববিদ্যালয় কেন তার দায় নেবে? এই গরমিলের বিষয়টি আগে থেকে জানতাম না। ওয়েবসাইটে ফল প্রকাশের আগে আমরা যাচাই করেছিলাম। কিন্তু যাচাই প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই ওয়েবসাইটে ফল প্রকাশ করা হয়। এই দায় আমাদের নয়।’
বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে ফোন দিলে তার একান্ত সচিব জানান তিনি চোখের ডাক্তার দেখাতে হাসপাতালে আছেন। পরে যোগাযোগ করা হলে উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. নুরুল আলম বলেন, ‘আমি বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ। আমি ঘটনা জানি না। আমি ডিন মহাদয়ের সাথে এবং রেজিস্ট্রারের সাথে কথা বলবো। দেখি আসল ঘটনা কী।’
প্রসঙ্গত, গত ২৮ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচিত প্রার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম চলে। এরপর ৩ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ভর্তি নিশ্চিতকরণ কার্যক্রম, চ ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সারাবাংলা/এমও