Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৮


৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৮:৪৫

।।ফারুক ওয়াহিদ।।

৮ ডিসেম্বর ১৯৭১, বুধবার। এদিন বাংলাদেশে বইছে মিত্র-মুক্তিবাহিনীর বিজয় ও মুক্তির প্লাবন। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের পতন হয়। কুমিলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর তথা বৃহত্তর কুমিল্লা মুক্ত হয়। তবে একমাত্র অবরুদ্ধ ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া- ময়নামতি থেকে শুধু হানাদার পাকিস্তানিদের জীবন্ত ধরে আনা বাকি। কুমিল্লা বিমান বন্দরে হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিসেনারা আর্টিলারি আক্রমণ চালিয়ে শেষ রাতের দিকে তাদের আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হয়। রাতব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধে ২৬ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হানাদার বাহিনীর কতিপয় সেনা বিমান বন্দরের ঘাঁটি ত্যাগ করে শেষ রাতে বরুড়ার দিকে এবং সেনানিবাসে ফিরে যায়। কুমিল্লা বিমান বন্দরের ঘাঁটিতে ধরা পড়া কতিপয় পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে।

আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৭

বিজয়ে কমিল্লার রাস্তায় নেমে আসে জনতার ঢল। কুমিল্লার আপামর জনগণ মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের ফুলের পাপড়ি ছিটিয়ে মুক্তির উল্লাসে বরণ করে নেয়। বিজয়ের আনন্দে মিত্রবাহিনীর শিখ সৈন্যদের দুই নয়ন ছিল অশ্রুসিক্ত তবে সে অশ্রু ছিল আনন্দের অশ্রু। বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী জনতার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। তৎকালীন পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী দলীয় পতাকা এবং মুক্ত কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক অ্যাডভোকেট আহমদ আলী বাংলাদেশের সোনালি মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৬

যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত হওয়ার পর সর্বত্র উড়ানো হয়েছে সোনালি-লাল-সবুজ পতাকা- বইছে বিজয়ের আনন্দ- জয়বাংলা স্লোগানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রকম্পিত হয়ে উঠছে। চাঁদপুরে বিজয়ের আনন্দের সুবাতাস বইছে। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ট্যাংক নিয়ে চাঁদপুরে প্রবেশ করে এবং পলায়নপর হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর লঞ্চ ডুবিয়ে দেয় এবং চাঁদপুর সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়।

আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৫

মেঘনা নদীর পূর্বপার মিত্র-মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে তবে কিছু বিচ্ছিন্ন জায়গা ছাড়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর তখনও মুক্ত হয়নি। তবে পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি চারদিকে তিতাস-ডোলভাঙা নদী বেষ্টিত বাঞ্ছারামপুর থানা মুক্তিযোদ্ধারা অবরুদ্ধ করে রাখে। আমরা (লেখকের গ্রুপ) মুক্তিযোদ্ধারা যখন থানা ঘেরাও করে রাখি তখন দেখেছি মিত্রবাহিনীর জলপাই রঙ-এর ঝাঁকে ঝাঁকে হেলিকপ্টারগুলো আমাদের মাথার ওপর দিয়ে ডেমরা- রূপগঞ্জের দিকে তথা ঢাকার উপকণ্ঠের দিকে খুব নিঁচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কৃষক ধানকাটা বাদ দিয়ে কাস্তে হাতে হাসিমুখে উৎসুক দৃষ্টিতে ছুটে যাওয়া হেলিকপ্টার গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখছে আর চিৎকার করে জয় বাংলা বলছে। মিত্র-মুক্তিবহিনীর পূর্বাঞ্চলের অধিনায়ক লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরা কুমিল্লা বিমান বন্দরে অবতরণ করে কুমিল্লার মুক্তিকামী জনসাধারণের অভিবাদন গ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৪

এদিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট মিত্র-মুক্তিবাহিনী দখল করে নেয়। দাউদকান্দি, ইলিয়টগঞ্জ, বিদ্যাকূট, মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল, সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), হাজিগঞ্জ, মিরসরাই (চট্টগ্রাম) মুক্ত। আরও মুক্ত হয় ঝালকাঠি, কালকিনি (মাদারীপুর), দৌলতপুর (কুষ্টিয়া), মিরপুর (কুষ্টিয়া), মেলান্দহ (জামালপুর)।চাঁদপুর নদীবন্দর অবরুদ্ধ। মাগুরা মুক্ত। এতো মুক্ত এলাকার খবর আসতে থাকে বর্ণনা দিতে থাকলে মহাকাব্য রচিত হবে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর সবেধন নীলমনি দুইটি স্যাবার জেটকেও মিত্রবাহিনী ভূপাতিত করে এবং পাকিস্তানের হাতে এখন রয়েছে শূন্য বিমান- বাংলার নীলাকাশ সম্পূর্ণ মুক্ত।

আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৩

চল চল ঢাকা চল- মিত্র-মুক্তিবাহিনী শহর-নগর-বন্দর-গ্রাম একের পর এক ঝড়ের বেগে জয় করে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু এলাকা পায়ে হেঁটে বা ডাবল মার্চ করতে করতে জয় করছে। বিজয় ও মুক্ত এলাকার একসাথে এতো তাজা খবর আসতে থাকায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্তি-মিত্র বাহিনীর এই দ্রুতগতির অগ্রযাত্রাকে আরও উৎসাহ দেওয়ার জন্য বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত রক্তগরম করা রণসংগীত বাজাতে থাকে:

“চল চল চল!/ চল চল চল!/ ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল/ নিম্নে উতলা ধরণি তল,/ অরুণ প্রাতের তরুণ দল/ চল রে চল রে চল/ চল চল চল।।/ ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত/ আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,/ আমরা টুটাব তিমির রাত,/ বাধার বিন্ধ্যাচল।/ নব নবীনের গাহিয়া গান/ সজীব করিব মহাশ্মশান,/ আমরা দানিব নতুন প্রাণ/ বাহুতে নবীন বল।/ চল রে নও-জোয়ান,/ শোন রে পাতিয়া কান/ মৃত্যু-তোরণ-দুয়ারে-দুয়ারে/ জীবনের আহবান।/ ভাঙ রে ভাঙ আগল,/ চল রে চল রে চল/ চল চল চল।”

আরও পড়ুন- ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ২

হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুক্ত বিচরণ ক্ষেত্র আর নাই- সবক্ষেত্রেই তারা পরাস্ত- সারা বাংলাদেশেই তারা অবরুদ্ধ হয়ে রয়েছে- আত্মসমর্পণ করছে অথবা আত্মসমপর্ণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মিত্র-মুক্তি যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল মানেকশ’ বিভিন্ন ভাষায় ছাপানো পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের বাণী ও লিফলেট বিমান থেকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। লিফলেটের বাণীতে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এ আশ্বাস দেন যে, আত্মসমর্পণ করলে তাদের প্রতি জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে। কিন্তু রণাঙ্গনে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা প্রকৃত অর্থে চাচ্ছিলেন হানাদার পাকিস্তানিরা এভাবে সারেন্ডার না করুক। আমরা চাচ্ছিলাম পাকিস্তানিদের যুদ্ধের মাধ্যমে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে জীবনের তরে বাংলার বুকে উচিত শিক্ষা দেওয়া- কিন্তু মিত্রবাহিনী আমাদের মনের অবস্থা ঠিকই বুঝে ফেলেছিল। এদিকে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুক্ত এলাকার জনগণের উদ্দেশ্যে সুশৃঙ্খলতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা প্রচার করা হচ্ছে।

লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

বিজয় নিশান মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর