Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৯


৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৯:০৮

।। ফারুক ওয়াহিদ।।

৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ দিনটি ছিল বিজয়ের বৃহস্পতিবার। হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সবজায়গায় অবরুদ্ধ হয়ে আছে- তারা এখন পলায়নপর এবং প্রতিরোধ যুদ্ধে নেমেছে। আজকের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেওয়ার সময় নেই- কারণ এই মুহূর্তে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে দেয়ার মতো কিছুই নেই।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-চাঁদপুর মুক্ত হওয়ার পর মিত্র-মুক্তিবাহিনী এখন আরো উৎসাহ নিয়ে দাউদকান্দি মুক্ত করে ঢাকার দিকে বীরের বেশে যুদ্ধ করতে করতে সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। মিত্র-মুক্তিবাহিনীর হামলায় টিকতে না পেরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকার দিকে পালাতে থাকে। দাউদকান্দি মুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে মূলত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থানা ছাড়া মেঘনার সম্পূর্ণ পূর্বাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

সবদিকে দিয়ে মিত্র-মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাইরে থেকে হানাদার বাহিনীর প্রবেশ রুদ্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে মুক্তি-মিত্রবাহিনী একে একে আশুগঞ্জ, ময়মনসিংহ, ত্রিশাল, নকলা, ঈশ্বরগঞ্জ, নেত্রকোণা মুক্ত করে। আশুগঞ্জ থেকে পালানোর পথে পাকিস্তনি সৈন্যরা ভৈরব মেঘনা সেতুর একটা স্পেন উড়িয়ে দেয়। ভৈরব বাজারে শত্রু তথা পাকিস্তানি পক্ষের দুইটি স্টিমার বিধ্বস্ত। পূর্বাঞ্চলীয় যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়ে জানান ঝিনাইদহে পাকিস্তানি সেনারা পাঁচশ ট্রাক ও মাগুরায় একশ ট্রাক বোঝাই রসদ ফেলে দিয়ে পালিয়েছে। এদিকে যশোর ক্যান্টনমেন্ট দখল করতেও মিত্র-মুক্তিবাহিনীর একটি গুলিও খরচ করতে হয়নি এবং কোনো বাধাও আসেনি। মিত্রবাহিনী এসেছে শুনে পাকিস্তানি সৈন্যরা পালিয়ে যায়। পেছনে ফেলে যায় বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও রসদ। হায়! তথাকথিত বিশ্বের সেরা পাকিস্তানি সৈন্য! এই হলো গণহত্যাকারী নারীধর্ষক পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহসের নমুনা।

মিত্র-মুক্তিবাহিনী এই দিনে গোয়ালন্দ ঘাট, গাইবান্ধা, পাইকগাছা, কুমারখালী, শ্রীপুর, অভয়নগর, পূর্বধলা ও চট্টগ্রামের নাজিরহাটসহ বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। রংপুর, দিনাজপুর মুক্ত হওয়ার পথে। মুক্তএলাকায় এই দিনে চারদিকে উড়তে থাকে বাংলাদেশের সোনালি মানচিত্র খচিত লালসবুজের বিজয় পতাকা।

একাত্তরের এদিন সকালে হানাদার বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দফতর ঢাকা থেকে প্রথমবারের মতো জেনারেল নিয়াজী স্বীকার করেন জল, স্থল ও আকাশপথে তাদের অবস্থা সংকটপূর্ণ- তাছাড়া আকাশ সম্পূর্ন শত্রুর নিয়ন্ত্রণে। এই বলে রাওয়ালপিন্ডিতে সংকেত বার্তা পাঠান। এদিকে আকাশ, জলে, স্থলে সবদিকে হানাদাররা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ায় জেনারেল নিয়াজি রাওয়ালপিন্ডিতে মেসেস পাঠান ‘আরো সাহায্য চাই।’

এদিকে মিত্র-মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনারা দলে দলে আত্মসমর্পণ শুরু করে- শুধু কুমিল্লার ময়ানমতিতেই আত্মসমর্পণ করে এক হাজার ১৩৪ জন। আর সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করে ৪৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অধিনায়কসহ ১০৭ পাকিস্তানি সেনা। খুলনা, বগুড়া ও চট্টগ্রামে হানাদারদের সঙ্গে মিত্র-মুক্তিবাহিনীর অবিরাম যুদ্ধ চলে।

আজ ৯ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার থেকে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের সব অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়- স্তব্ধ হয়ে যায় রেডিও পাকিস্তান ঢাকা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিওতে বসে বার্তা বিভাগীয় প্রধান কামাল লোহানী, আলী যাকের ও আলমগীর কবির ঘন ঘন সংবাদ বুলেটিন পরিবর্তন ও পরিবেশন করেন ও ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তারা সর্বশেষ বুলেটিন প্রচার করতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন- প্রতি মুহূর্তে খবর আসছে বিভিন্ন জেলা, মহকুমা ও থানা মুক্ত হওয়ার বিজয়ের খবর।

এদিকে যুদ্ধ জয়ের নিশ্চয়তা জেনেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশ থেকে জাতিসংঘের যেসব কর্মী, কূটনৈতিক, প্রতিনিধি ও বিদেশি নাগরিক নিরাপদে সরে আসতে চান বাংলাদেশ সরকার তাদের সম্ভাব্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেবে।”

ঢাকার উপকণ্ঠে মিত্র-মুক্তিবাহিনী ঢুকে পড়েছে এবং জনসাধারণও মিত্র-মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করারা জন্য রাজপথে নেমে এসেছে। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একটি চিঠি দিয়ে চিঠিতে উল্লেখ করেছেন- বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সর্বত্র বিজয়ী মিত্র বাহিনীর জওয়ানদের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছেন এবং বাংলাদেশের মানুষ তাদের ‘মুক্তিদূত’ বলে অভিহিত করেছেন।

“প্রয়োজনে হলে ভারতীয় জওয়ানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিবাহিনীও ভারতের পশ্চিম রণাঙ্গনে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন”- হ্যাঁ এধরনের বীরত্বপূর্ণ ঘোষণা আসে আজ- নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে মিশনের প্রধান জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এই কথা ঘোষণা করেন। জনাব চৌধুরী বলেন, মানবতার স্বাধীনতা রক্ষার এই পবিত্র যুদ্ধে আজ দুই দেশের বীর যোদ্ধারা সামিল হয়েছে। মহূর্তের মধ্যে ‘আকাশবাণী’-র মাধ্যমে এই ঘোষণার খবরটি চলে আসে রণাঙ্গনে- রণাঙ্গনে থাকা অবস্থায় আমরা মুক্তিযোদ্ধারা জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়ি এবং স্বপ্ন দেখতে থাকি বাংলাদেশ জয়ের পর বাংলাদেশের স্বর্ণালি মানচিত্র খচিত লাল-সবুজ জয়ের পতাকা মিত্রবাহিনীর সাথে মিলে পাকিস্তানের ইসলামাবাদ-লাহোরে একদিন উড়াবই- “একদিন সূর্যের ভোর/ একদিন স্বপ্নের ভোর/ একদিন সত্যের ভোর/ আসবেই…।”

আমরা করবো জয়!/ আমরা করবো জয়!/ আমরা করবো জয়!/ একদিন …/ আহা বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়/ আমরা করবো জয়!/ একদিন … ।।/ একদিন সূর্যের ভোর/ একদিন স্বপ্নের ভোর/ একদিন সত্যের ভোর/ আসবেই…/ এই মনে আছে বিশ্বাস/ আমরা করি বিশ্বাস/ সত্যের ভোর আসবে/ একদিন… ।।/ পৃথিবীর মাটি হবে মধুময়/ বাতাস হবে মধুময়/ আকাশ হবে মধুময়/ একদিন …/ এই মনে আছে বিশ্বাস/ আমরা করি বিশ্বাস/ আকাশ হবে মধুময়/ একদিন … ।। আর নয় ধ্বংসের গান/ জনতার ঐকতান/ সৃষ্টির সুরে হবে গান/ একদিন …/ এই মনে আছে বিশ্বাস/ আমরা করি বিশ্বাস/ সৃষ্টির সুরে হবে গান/ একদিন … ।।/ আমরা মানি নাকো বাঁধা বন্ধন/ হাতে বাধি রাঁখি বন্ধন/ সামনে সত্যের জয়/ একদিন …/ এই মনে আছে বিশ্বাস/ আমরা করি বিশ্বাস/ সামনে সত্যের জয়/ একদিন … ।।/ আমরা করবো জয়!/ আমরা করবো জয়!/ আমরা করবো জয়!/ একদিন …/ আহা বুকের গভীরে আছে প্রত্যয়/ আমরা করবো জয়!/ একদিন … ।।/ আমরা করবো জয়!/ একদিন… ।।” (গানটির অনুবাদ: হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়)। [চলবে]

লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

একাত্তর বিজয় নিশান মুক্তিযুদ্ধ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর