ফ্রান্সে কেন থামছে না ইয়োলো ভেস্টধারীদের আন্দোলন?
৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৫:৫১
।। আন্তর্জাতিক ডেস্ক ।।
হলুদ রঙের নিরাপত্তা জ্যাকেট বা জিলে জোন পরে গত তিন সপ্তাহ ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ করছেন ফরাসিরা। জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ফ্রান্সজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন থামেনি সরকারের বাড়তি কর রহিতের আশ্বাসের পরও। সম্প্রতি আন্দোলনের হাওয়া লেগেছে বেলজিয়ামেও। হঠাৎ করে ইউরোপবাসীর এত ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ কি?
এ বিষয়ে ফ্রেদি বুয়্যেভার নামে এক ট্রাক চালক বলেন, আমরা রাজনীতিবিদদের আশ্বাস শুনতে শুনতে ক্লান্ত। ফরাসিরা তাদের আর বিশ্বাস করে না। কর স্থগিত বা বাতিল যাই হোক না কেন আমরা দ্রুত বাস্তবায়ন চাই।
উল্লেখ্য, দু হাজার সালের পর ফ্রান্সে জ্বালানির দাম এখন সর্বোচ্চ। আসছে বছরের শুরু থেকে ডিজেলে প্রতি লিটারে কর ৬.৫ সেন্ট ও পেট্রোলে ২.৯ সেন্ট বাড়ানোর সরকারি ঘোষণার প্রেক্ষিতে গত ১৭ নভেম্বর সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে নামে গাড়ি চালকেরা। পরবর্তীতে তাদের সাথে আন্দোলনে সংহতি জানান সাধারণ ফরাসিরাও।
শহর থেকে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যন্ত গ্রামে। আন্দোলন সংশ্লিষ্ট ঘটনায় এ পর্যন্ত চার জনের মৃত্যু হয়েছে। কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকায় কার সঙ্গে কথা বলে আন্দোলন প্রশমিত করা যাবে বুঝতে পারছে না ফরাসি কর্তৃপক্ষও। ইতোমধ্যে, প্রায় হাজার খানেক ইয়োলে ভেস্টধারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
আন্দোলনকারী ক্লদে রিগলেদ জানান, তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, কমেছে আয়। তাই বাইরে রেস্তোরাঁয় গিয়ে কখনো খাওয়া অথবা সপ্তাহে ছুটির দিনে কোথাও অবকাশযাপন নূন্যতম বিলাসিতার এসব কিছুই সম্ভব হয়না। এখানে সবকিছুর দাম বেশি। বাসস্থান, গাড়ি ক্রয় বাড়তি করের কারণে সবকিছু নাগালের বাইরে।
ম্যাঁখো সরকার ক্ষমতায় আসার আগে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলে দাবি তাদের। তাই বয়স, চাকরি বা শ্রেণিভেদে মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো এই আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন।
রেমিস নামে এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, দরিদ্র লোকদের সরকার চরমভাবে আঘাত করে যাচ্ছে। আমার স্বামী ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে চাকরি করে। আমরা সচ্ছল নই। মাস শুরু হবার আগেই দেনায় পড়েছি।
তিনি আরও বলেন, মাসের মাঝেই ছেলেমেয়েদের গিফট ভাউচার ভাঙ্গিয়ে আমাদের খাদ্য কিনতে হচ্ছে। এটা কলঙ্কের মতো। সবকিছু এভাবে চলতে পারে না। আমরা বেঁচে নেই, টিকে আছি।
বৃদ্ধাশ্রমে সেবা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা ডেলপাইন নোটলেট বলেন, ম্যাঁখো আমাদের কথা শুনতে চায় না। আমরা তাকে বুঝাতে চাই। আমরা পুতুল নই নাগরিক। ট্যাক্স আমাদের গিলে খেতে পারে না।
ফরাসিদের সরকার বিরোধী এই মনোভাবের সুযোগ পেয়ে বহির্বিশ্বও নাক উঁচু পশ্চিমাদের গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ইউরোপকে খোঁচা দিয়ে বলেছেন, সেখানে নড়বড়ে গণতন্ত্র চালু আছে।
ফ্রান্সের আন্দোলন এতটাই তীব্র যে, শনিবার বন্ধ রাখা হয়েছে প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, লুভর জাদুঘরসহ ১৫টি পর্যটনস্থল। আন্দোলনকারীরা আগেই ক্ষতি করেছে স্থাপত্য আর্ক ডি ট্রায়াম্ফ-এর। এসব সামলাতে ফ্রান্সজুড়ে ৯০ হাজার নিরাপত্তারক্ষী দায়িত্ব পালন করছেন।
তবে দোকানে লুণ্ঠন, সরকারি সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি, গ্রেফতার ও প্রাণহানি সত্ত্বেও আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থন কমেনি। দেশটির শতকরা ৭৮ ভাগ লোক আন্দোলনে তাদের সহমর্মিতা জানিয়েছেন। শতকরা ৪৭ ভাগ মানুষও মনে করছেন আন্দোলন সহিংসতার পর্যায়ে চলে গেছে। তবে এসব সরকার ও সিস্টেমের প্রতি নাগরিকদের ক্ষোভের প্রতিচ্ছবি বলেই সবার ধারণা।
এদিকে ফ্রান্স সরকার মন্তব্য করছে ‘আন্দোলন চুরি’ হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বিরোধীদের যোগসাজশে আন্দোলনের সুবিধা নিচ্ছেন। তবে দেশটিতে এখনই জরুরি অবস্থা জারির মতো বিষয় নিয়ে ভাবছে না ম্যাঁখো সরকার।
স্থানীয় সংবাদপত্রগুলো জানায়, আন্দোলন বেগবান করতে ইয়োলো ভেস্টধারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করেছে। ল্যা ফ্রান্স এন কোলরে বা অ্যাংগ্রি ফ্রান্স নামে একটি ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে থাকেন। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এই গ্রুপটি সক্রিয় ছিলো। ফেসবুকে প্রকাশিত মেমে, ছবি ও লেখাগুলো সাধারণ মানুষদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছে। শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামেও আন্দোলন জোরদার করে এমন সক্রিয় অনেক গ্রুপ তাদের রয়েছে।
ফ্রান্সের চলমান আন্দোলন ইউরোপে ‘আরব বসন্তের’ মতো জোরদার কোন বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটালো তা এখনই বলা যাবে না। তবে সাধারণ মানুষরা নিজেদের দৈনন্দিন জীবনের অপ্রাপ্তি ও ক্ষোভ প্রকাশে পশ্চিমা সরকার ও রাজনীতিবিদদের জোরালো বার্তা দিতে সফল হয়েছে। তা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে।
বিবিসি অবলম্বনে
সারাবাংলা/এনএইচ