খাগড়াছড়িতে সমীকরণে এগিয়ে আ.লীগ, আসন পুনরুদ্ধারে মরিয়া বিএনপি
১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৯:১৯
।। ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
খাগড়াছড়ি: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ নম্বর পার্বত্য খাগড়াছড়ি অাসনে একক প্রর্থী চূড়ান্ত করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দুই দলের প্রার্থী চূড়ান্তের পর নানা হিসাব-নিকাশে এগিয়ে আছে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা।
জেলা রিটার্নিং অফিস সুত্রে জানা গেছে, দলীয় মনোনয়ন না থাকায় সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সমীর দত্ত চাকমার মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
অন্যদিকে, মামলায় সাজা স্থগিত না হওয়ায় বিএনপি সভাপতি ওয়াদুদ ভূঁইয়ার মনোনয়ন এবং আরপিও অনুযায়ী বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সঠিক না থাকায় ইউপিডিএফ সমর্থিত নতুন কুমার চাকমা ও সচিব চাকমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ির এই আসনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্ধিতার জন্য শেষ দিন (গত ২৮ নভেম্বর) পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ১১ প্রার্থীর মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। তবে ২ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাইয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বর্তমান সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, বিএনপি থেকে শহীদুল ইসলাম ফরহাদ, সমীরণ দেওয়ান, গণফোরাম থেকে আমজাদ হোসেন চৌধুরী, জাতীয় পার্টির (এরশাদ) সোলাইমান আলম শেঠ ও ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আবদুল জব্বার গাজীর মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি কল্যাণ মিত্র বড়ুয়া বলেন ১৯৭০ সালে তিন পার্বত্য জেলা মিলে ১টি আসন ছিলো। সেই সময় পার্বত্য চট্রগ্রাম জন সংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে আসনটিতে জয়লাভ করেন জাসদ (আসম আবদুর রব) প্রার্থী উপেন্দ্র লাল চাকমা, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) প্রার্থী এ কে এম আলিম উল্ল্যাহ, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কল্প রঞ্জন চাকমা, ২০০১ ও ২০০৬ সালে বিএনপির প্রার্থী ওয়াদুদ ভুইয়া, ২০০৮ সালে যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা জয়লাভ করেন। স্বাধীনতার পর থেকে বিগত দশটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে সর্বাধিক চার বার নির্বাচিত হয়েছে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা।
খাগড়াছড়ির এই আসনটি বরাবরই আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। অন্য দলের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের থেকে অনেকে ব্যবধানে পিছিয়ে থাকে।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা মনে করছেন, গত এক দশকে খাগড়াছড়িতে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এর ফলে খাগড়াছড়ি এখন শান্তি ও উন্নয়নের এলাকা। এই ধারা অব্যাহত রাখতে খাগড়াছড়িবাসী আওয়ামী লীগ প্রার্থীকেই বেঁছে নেবে।
জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মালেক মিন্টু বলেন, ‘নির্বাচনকে প্রভাবিত করার জন্য সরকার নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে খাগড়াছড়ি জেলার জনপ্রিয় নেতা, দুদুবারের সংসদ সদস্য, পার্বত্য চট্রগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সফল চেয়ারম্যান ওয়াদুদ ভুইয়াসহ বিভিন্ন হেভিওয়েট প্রার্থীর নমিনেশন বাতিল করেছে।’
নমিনেশন বাতিল হওয়া ষড়যন্ত্রমুলক উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জেলা বিএনপির সভাপতি যে মামলায় সাজাপ্রাপ্ত একই ধরণের মামলায় আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জ্বল হোসেন মায়া, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, হাজী সেলিম, জাতীয় পার্টির এরশাদসহ বিভিন্ন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতারাও সাজাপ্রাপ্ত। সরকারের সমর্থিতরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারলে, বিএনপি ও যুক্তফ্রন্ট নেতারা কেন পারবেন না।’
এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল মালেক মিন্টু বলেন, ‘প্রথম থেকে ধারণা করা হচ্ছিল, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরার শক্ত প্রতিপক্ষ হবে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী ওয়াদুদ ভুইয়া। জাতীয় দুই বড় দলের সঙ্গে হাডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাসও ছিলো। কিন্তু বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী ওয়াদুদ ভুঁইয়া ও ইউপিডিএফ-এর নতুন কুমার চাকমা ও সচিব চাকমার নমিনেশন বাতিল করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ভালো অবস্থানে থাকার স্বপ্ন দেখলেও তা সফল হবে না। তৃণমূল থেকে শুরু করে জেলা বিএনপি ও অঙ্গ-সংগঠনের সকল নেতা-কর্মী এই নির্বাচনে দলের মনোনীত প্রার্থী শহিদুল ইসলাম ফরহাদকে জেতানোর জন্য মরিয়া হয়ে কাজ করবে।’
বিএনপির হয়ে মনোনয়ন জমা দেওয়া নেতা সমীরণ দেওয়ান সম্পর্কে বলেন, সমীরণ দেওয়ান বিএনপির কেউ না। জাতীয় পার্টির সময় জাতীয় পার্টিতে যোগদান করে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হয়েছেন, আওয়ামী লীগের পিরিয়ডে আওয়ামী লীগে যোগদান করেছিলেন এবং এখন বিএনপি-বিএনপি করছেন।’
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও খাগড়াছড়ি জেলা ইউনিটের প্রধান সংগঠক উজ্জ্বল স্মৃতি চাকমা বলেন, ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮ নং খাগড়াছড়ি আসনে ইউপিডিএফ-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী সচিব চাকমা ও নুতন কুমার চাকমার মনোনয়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত ষড়যন্ত্রমূলক, পক্ষপাতদুষ্ট ও অযৌক্তিক।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘ইউপিডিএফকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে ও একটি বিশেষ দলের প্রার্থীকে বিগত দশম সংসদ নির্বাচনের মতো ছলে-বলে কৌশলে জয়যুক্ত করতে একটি বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে ঠুনকো ও মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে উক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
ইউপিডিএফ নেতা জনগণকে বিশেষ মহলের গণবিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন ও সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আসন্ন নির্বাচনকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃহত্তর আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে বিজয়ের জন্য অবশ্যই সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’
খাগড়াছড়ি জেলা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জেলা বিএনপির সভাপতি ওয়াদুদ ভুইয়াসহ পাঁচ প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র বাতিলে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থী। তবে মনোনয়ন পত্র বাতিলের কারণে ইউপিডিএফ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলায় এবছর মোট ভোটার সংখ্যা ৪ লক্ষ ৪১ হাজার ৬৮ জন। গত সংসদ নির্বাচনে ভোটার ছিল ৩ লাখ ৮১ হাজার ৫ শ ১৬ জন। গত দুটি নির্বাচনে ইউপিডিএফের প্রার্থীরা ৬০-৬৫ হাজার ভোট পেয়েছিলো। এবার নতুন ভোটার সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার। যার অধিকাংশই তরুণ প্রজন্মের। তরুণ প্রজন্মের মাঝেও ইউপিডিএফের একটি অংশ ভোঠে থাকবে। যেহেতু গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর প্রায় এক লাখ ভোটের সঙ্গে এই ভোটের একটি অংশ আওয়ামী লীগে এবং আরেকটি অংশ বিএনপি পেলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীই এগিয়ে থাকবে।
জেলা রিটানিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আইন অনুযায়ী পাঁচ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। কোন প্রার্থী হেভিওয়েট আর কোন প্রার্থী লো ওয়েট তা দেখার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের নয়। যাদের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে তা আইনমতেই করা হয়েছে। আপনারা জানেন মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিল ৯ ডিসেম্বর। ইতিমধ্যে বৈধ হওয়া মনোনয়ন পত্র এবং বৈধ প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিনে প্রার্থীর সংখ্যা আরও কমে এবং ঠিক কতজন চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে রয়েছে তাও নির্ধারণ করা হয়েছে।’
সারাবাংলা/এমআই