স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে প্রতিবছর দরিদ্র হচ্ছে ৫২ লাখ মানুষ
১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪:০০
।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: স্বাস্থ্যখাতে ২০১২ সালে একজন মানুষের ব্যয় হতো ৬০ শতাংশ, আগামী ২০৩২ সাল নাগাদ সে ব্যয় কমিয়ে ৩২ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও বর্তমানে ব্যয় হচ্ছে ৬৭ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মাদ নাসিম একাধিকবার বলেছেন, টাকার অভাবে দেশের কোনো মানুষ চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও স্বাস্থ্য বীমা কার্যকর হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলছে, হঠাৎ করে বড় কোনো দুর্যোগে পড়লে স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষ। আর স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ জানিয়েছে, দেশের ৬৪ শতাংশ মানুষ নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে চিকিৎসা করাচ্ছেন, আবার চিকিৎসার জন্য যে টাকা খরচ হচ্ছে সেখানে ৭০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে ওষুধ কেনার জন্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ। আবার বাংলাদেশে ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্ট ( এএনএইচ) জানাচ্ছে জনপ্রতি ১০০ টাকার মধ্যে ৬৭ টাকা খরচ হচ্ছে মানুষের পকেট থেকে।
একইসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশের মানুষ মানুষ স্বাস্থ্যসেবার ৬০ শতাংশ পায় অসংগঠিত খাত থেকে। সরকারিখাত থেকে সেবা আসে ১৪ শতাংশ। আর বেসরকারি খাত থেকে মানুষ ২৬ শতাংশ সেবা পায়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বাস করছে এবং প্রতিবছর শুধু অসুস্থতার কারণে প্রায় ৬৪ লাখ মানুষ দারিদ্র্যের শিকার হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যসেবার এ খরচ মেটাতে গিয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন এবং গরিব থেকে আরও গরিব হয়ে যাচ্ছে এ সব মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস বা এসডিজিস এর ১৭টি উদ্দেশ্যের মধ্যে অন্যতম। অথচ আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দরকার। তা না হওয়ায় দেশে ধনী-গরিব সব শ্রেণীর মানুষ চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে বাধ্য হচ্ছে। আর এ ব্যয়ের জন্য দেশের ১৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।
তারা বলছেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা আরও বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সরকারের উচিত হবে তাদের দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করা।
স্বাস্থ্যখাতের ব্যয় কমাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার উপর জোর দেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।
ডা. রাসকিন বলেন, দেশের স্বাস্থ্য সেবাকে দৃঢ় করতে হলে তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসা সেবাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের রোগীদের জন্য সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে যেন তাদেরকে টাকা খরচ করে ঢাকায় না আসতে হয়। তিনি বলেন, যে কোনো অসুখে আক্রান্ত হলে রোগীদের উন্নত চিকিৎসার জন্য তারা ঢাকায় আসেন। এতে করে রোগীদের শারীরিক কষ্টের সঙ্গে যোগ হয় চিকিৎসা ব্যয় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয়।
তার বিভাগের কথা উল্লেখ করে ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, এজন্য প্রতিটি বিভাগে একটি করে ক্যান্সার স্পেশালাইজড হাসপাতাল করতে হবে।
দেশে প্রতিবছর নতুন করে ১ লাখ ২০ হাজার ক্যান্সারাক্রান্ত রোগী বাড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে এত রোগীর জায়গা হয় না, তাদের বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হয় বেসরকারি ক্লিনিক ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে। কিন্তু বিভাগীয় পর্যায়ে যদি একটি করে ক্যান্সার হাসপাতাল তৈরি করা যায় তাহলে রোগীদের আর্থিক ব্যয় যেমন কমবে তেমন ঢাকার হাসপাতালেও রোগীর চাপ কমে যাবে।
চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের জন্য ব্যক্তির পকেটের ব্যয় বাড়লে তা অনেক পরিবারের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বছরে দেশে ১৩ শতাংশ পরিবারে আর্থিক বিপর্যয় ঘটে, ৪ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে যায়।’
স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগ থেকে জানা যায়, ২০১২ সালে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়নে কৌশলপত্র তৈরি করে। তখন স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ব্যক্তি নিজে বহন করত।
কৌশলপত্রে বলা হয়েছিল, ব্যক্তির নিজের খরচের অংশ ধীরে ধীরে কমানো হবে। পাশাপাশি সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। গত কয়েক বছরে দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তির ব্যয় বাড়ছে। বর্তমানে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৭ শতাংশ ব্যক্তি নিজের পকেট থেকে দেয় জানিয়ে অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশে ব্যক্তির পকেটের খরচ বেশি।
সারাবাংলা/জেএ/একে