সংসদ নির্বাচন নিয়ে পূর্বের দেশগুলো স্বস্তিতে, পশ্চিমারা সংশয়ে
১৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৯:০৭
।। এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: আন্তর্জাতিক অঙ্গণের গভীর পর্যবেক্ষণে বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। পাকিস্তান বাদে বাংলাদেশের প্রতিবেশি এবং পূর্ব অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো এই নির্বাচন নিয়ে স্বস্তিতে থাকলেও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে সংশয় কাজ করছে। একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানাচ্ছে, বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে কোনো সংশয় নেই। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের ওপর দেশ দুইটির আস্থা আছে। এই দুইটি দেশ মনে করে, চলমান সরকারের অধীনে সামনের নির্বাচন শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য হবে।
অন্যদিকে, পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সংশয় রয়েছে। তারা মনে করে, নির্বাচনে ব্যাপক রক্তপাতের শঙ্কা আছে। একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে, শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো সারাবাংলা’র সঙ্গে একান্ত আলাপে বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সহিংসতা রয়েছে। আমরা আশা করব, এই নির্বাচনে যতোটা পারা যায় সহিংসতা কম হবে।’
মিয়া সেপ্পো বলেন, ‘আমরা চাই, একটি শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন করছে তা ধরে রাখতে হলে শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। একটি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতার জন্য শান্তিপূর্ণ নির্বাচন জরুরি। রাষ্ট্রে স্থিতিশীলতা না থাকলে উন্নয়নের গতি এগিয়ে নেয়া যায় না।’
ভারতের একটি কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অধীনে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হবে বলে নরেন্দ্র মোদীর সরকার বিশ্বাস করে। এ ছাড়া ভারত চায় না ধর্মনিরপেক্ষ বর্তমান সরকারের বাইরে ইসলামপন্থী কোনো শাসক বাংলাদেশের চালকের আসনে বসুক। এ জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী এই সরকারকে আবারো ক্ষমতায় দেখতে চাওয়ার কথা একাধিকবার প্রকাশ্যে ব্যক্ত করেছেন।
বর্তমান সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের কারণে ভারত তার পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের সন্ত্রাস নির্মূলে শক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশের আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই ওই অঞ্চলের উন্নয়ন কাজ চালিয়ে নিতে ভারতের সহজ হচ্ছে। এ ছাড়া জ্বালানি, যোগাযোগসহ একাধিক খাতেই ভারত বাংলাদেশের সহযোগিতা পাচ্ছে। তাই ভারত কোনোভাবেই চায় না যে ইসলামপন্থী কোনো দল বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসুক।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রাভেশ কুমার বলেছেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি এবং বন্ধু রাষ্ট্র। এই নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা শোভা পায় না।’
চীনের একটি সূত্র জানায়, ভারতের নিষেধ থাকা সত্বেও বাংলাদেশ চীনের উদ্যাগে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পে যোগ দিয়েছে। চীন এখন বাংলাদেশের বড় বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নসহ বেইজিংয়ের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ঢাকা বেইজিংয়ের পরামর্শ মেনে নিয়েছে। সার্বিকভাবে চীনের সঙ্গে বর্তমান সরকারের সম্পর্ক ইতিবাচক এবং ভালো। চীনও চায় না অন্য কেউ ক্ষমতায় আসুক।
ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ঝ্যাং জু বলেছেন, ‘আসন্ন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য হবে।’
অন্যদিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসনসহ একাধিক ইস্যূতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো বর্তমান সরকারের ওপর বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিয়ে আস্থা রাখতে পারছে না। আবার সন্ত্রাসী দল হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে প্রধান বিরোধী দলের ঐক্য থাকায় তাদের ওপরও পশ্চিমা এবং ইইউ রাষ্ট্রগুলো আস্থা রাখতে পারছে না।
পশ্চিমা বিশ্বের একজন কূটনীতিক জানান, আসন্ন নির্বাচন নিয়ে তারা সংশয়ে আছেন। মনে করছেন, এই নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা হতে পারে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বদলে বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী কংগ্রেসম্যান জিম ব্যাঙ্কস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের জন্য এই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু চরমপন্থা সংগঠন জামায়াতে ইসলামী আসন্ন নির্বাচনের জন্য বড় ধরণের হুমকি।’
ইইউ’র এক কূটনীতিক জানান, আর্ন্তজাতিক আদালতে জামায়াত একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হলেও দেশের প্রধান বিরোধী দল ওই সংগঠনকে ছাড়তে পারেনি। এই দলটি ক্ষমতায় আসলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে যে উৎসাহ দেয়া হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
ইইউ’র ঢাকা মিশনের ১০ জন রাষ্ট্রদূত এক বিবৃতিতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিখাদ, বিশ্বাসযোগ্য, অর্ন্তভূক্তিমূলক এবং স্বচ্ছভাবে অনুষ্ঠানের জন্য সরকার, নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং সবগুলো রাজনৈতিক দলের কাছে আহ্বান জানিয়েছে।
ওই বিবৃতিতে ইইউ’র ঢাকা মিশনের রাষ্ট্রদূতরা বলেন, ‘আসন্ন সংসদ নির্বাচনের প্রচারণা আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছে। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের প্রতি আহ্বান থাকছে যে ভোট উৎসবে জণগনের অধিকার যেন অক্ষুন্ন থাকে। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার অধিকার রক্ষার বিষয়ে সরকার এবং নির্বাচন কমিশন যে অঙ্গীকার করেছে, তা রক্ষা করবে বলে আশা করছি। সবগুলো রাজনৈতিক দল তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার লঙ্ঘণ করবে না এবং সহিংসতা প্রতিরোধে তাদের অঙ্গিকার রক্ষা করবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও আইনের ব্যতয় ঘটাবে না বলে বিশ্বাস করি।’
বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সবসময়েই উত্তপ্ত থাকে উল্লেখ করে যুক্তরাজ্যের হাউজ অব কমেন্স ‘বাংলাদেশ: নভেম্বর ২০১৮ আপডেট’ শীর্ষক প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, ‘সামনের নির্বাচনকে ঘিরে এই পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হতে পারে। সামনের নির্বাচন নিয়ে আর্ন্তজাতিক মহলের সংশয় আছে বলেই হয়তো ইইউ ভোটের মাঠে পুরো পর্যবেক্ষক দল না পাঠিয়ে দুইজন বিশেষজ্ঞ পাঠাচ্ছে।’
যুক্তরাজ্যের এশিয়া বিষয়ক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড বলেন, ‘বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সবদলের অংশগ্রহণে অর্ন্তভূক্তিমূলক চায় যুক্তরাজ্য সরকার। আমি গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অংশগ্রহনমূলক ভোটের কথা বলেছি। এ ছাড়া গত ১ নভেম্বর প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমকেও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছি।’
সারাবাংলা/জেআইএল/এসএমএন