সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় যোগাযোগে মহাপরিকল্পনা আ.লীগের
১৮ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৪:৫৫
।। সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যেতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। টানা তৃতীয় মেয়াদে যোগাযোগ-ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, সুগম ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে সড়ক, রেল ও নৌপথের সম্প্রসারণ এবং সংস্কার বাস্তবায়নকে গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকার খাত হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনি অঙ্গীকার করেছে দলটি।
ইশতেহার দেখতে ক্লিক করুন এখানে: আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার
মঙ্গলবার (১৮ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ স্লোগান নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮ ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
২১টি বিশেষ অঙ্গীকারকে গুরুত্ব দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী ইশতেহার-২০১৮ ঘোষণা করেছে।
সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় যোগাযোগে মহাপরিকল্পনা আ.লীগের
দলটির ঘোষিত ইশতেহারের বলা হয়েছে, উন্নয়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে—উন্নত দক্ষ ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থা। যোগাযোগ খাতে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে যে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে, তা এখন সর্বমহলে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকার খাত হিসেবে যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, সুগম ও নিরাপদ করার লক্ষ্যে সড়ক, রেল ও নৌপথের সম্প্রসারণ ও সংস্কার বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনি ইশতেহারের অঙ্গীকারে আরও উল্লেখ আছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে যোগাযোগ ও অবকাঠামো খাতে ৪৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো রাজনৈতিক দল সড়কপথ, রেলপথ, বিমানপথ ও জলপথ যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচি (রূপকল্প-২০২১ ও রূপকল্প-২০৪১) সামনে রেখে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। ইতোমধ্যে দেশবাসী এর সুফল পেতে শুরু করেছে।
সড়কপথ, রেলপথ ও বিমানপথের সাফল্য ও অর্জনগুলোও তুলে ধরা হয় নির্বাচনি ইশতেহারে। এতে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে দেশের বৃহত্তম পদ্মা বহুমুখী সেতুর ৬২ শতাংশ নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। সেতুটি নির্মাণ সম্পন্ন হলে জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক পদ্মাসেতু দক্ষিণ বঙ্গের মানুষের জীবনধারাই শুধু পাল্টাবে না, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে।
২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর কর্তৃক ৪ হাজার ৩৩১ কিলোমিটার সড়ক মজবুতকরণসহ ৫ হাজার ১৭১ কিলোমিটার মহাসড়ক প্রশস্ত এবং ৪ হাজার ৮৬৯ কিলোমিটার মহাসড়ক কার্পেটিং ও সিলকোট, ১ হাজার ৮৯২ কিলোমিটার ডিবিএসটি এবং ৮ হাজার ১৫৮ কিলোমিটার ওভারলে করা হয়েছে। ৪১৭ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার-লেনে উন্নীত করা হয়েছে সেগুলো তুলে ধরা হয়।
এ ছাড়াও ঢাকা মহানগরীর যানজট সমস্যা নিরসনে ও পরিবেশ উন্নয়নে উত্তরা (তৃতীয় পর্ব) হতে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। যার স্টেশন থাকবে ১৬টি এবং প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন সক্ষমতা থাকবে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ৭০৩ দশমিক ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে র্যাম্পসহ প্রায় ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পিপিপি প্রকল্প চলমান রয়েছে। ৯৩৫ দশমিক ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে গাজীপুর হতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত মোট ২০ কিলোমিটার বাস র্যাপিড ট্রানজিট নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে।
নির্বাচনী ইশতেহার অঙ্গীকারগুলোর মধ্যে রয়েছে, চীন সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী ১৬ হাজার ৯০১ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একটি প্রকল্পও সরকার সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছে। গত ১০ বছরে ৩৩০ হাজার ১৫ কিলোমিটার নতুন রেললাইন নির্মাণ, ৯১টি স্টেশন বিল্ডিং, ২৪৮ হাজার ৫০ কিলোমিটার মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজে রূপান্তর, নতুন ৭৯টি রেলস্টেশন নির্মাণ এবং ২৯৫টি রেলসেতু নির্মাণ করা হয়েছে। রেলওয়ের পরিকল্পিত উন্নয়নের জন্য ৩০ বছর মেয়াদি একটি মাস্টার প্ল্যান অনুমোদিত হয়েছে। ৪৩০টি যাত্রীবাহী কোচ পুনর্বাসন শেষে রেলওয়ের বহরে সংযুক্ত করা হয়েছে। লালমনিরহাট হতে বুড়িমারি, কালুখালী থেকে ভাটিয়াপাড়া ও পাঁচুরিয়া থেকে ফরিদপুর পর্যন্ত বন্দর রেল সেকশন পুনঃচালু করা হয়েছে।
এ ছাড়াও স্থানীয় সরকারের আওতায় ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫২ হাজার ২৮০ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন, ৭৫ হাজার ৭৭৩ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ৩১ হাজার ৬৩৭ মিটার ব্রিজ পুনর্নির্মাণ এবং ৩ লাখ ১ হাজার ৩৪১ মিটার কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ১০টি নতুন বিমান ক্রয় করা হয়েছে এবং আরও ৫টি কেনার চুক্তি হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
আগামী দিনে লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে ইশতেহারে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে ১৬ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩৯ হাজার ২৪ কিলোমিটার বিস্তৃত ঢাকা পূর্ব-পশ্চিম এলিভেটেড হাইওয়ে নির্মাণ করা হবে। ঢাকাকে ঘিরে একটি এলিভেটেড রিংরোড এবং ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণেরও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে এবং এক্সপ্রেস রেলওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মাত্র এক ঘণ্টার মধ্যে যাতে চট্টগ্রামে পৌঁছানো যায় সেজন্য বুলেট ট্রেন (দ্রুতগামী ট্রেন) চালু করা হবে। ক্রমে বুলেট ট্রেন সিলেট, রাজশাহী, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা এবং কলকাতা পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে। রাজশাহী, সিলেট, চট্টগ্রাম, বরিশাল বিমানবন্দরকে উন্নত করা হবে। ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরে থার্ড টার্মিনাল নির্মাণ, নতুন রাডার স্থাপন ও জেট ফুয়েল সরবরাহ করার জন্য পাইপলাইন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন করা হবে। কক্সবাজারে প্রতিষ্ঠা করা হবে সুপিরিয়র বিমান অবতরণে সক্ষম দেশের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন বিমানবন্দর। বাগেরহাটে খানজাহান আলী বিমানবন্দর নির্মাণ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। ইতোমধ্যে ‘নিরাপদ সড়ক আইন-২০১৮’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনটি প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্ঘটনা ন্যূনতম পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। আগামীতে সময়ের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে নতুন ধারা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মাধ্যমে এটাকে আরও যুগোপযোগী ও কার্যকর করা হবে।
নির্বাচনি ইশতেহারে নিরাপদ সড়কের জন্য লাইসেন্সবিহীন চালকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, ট্রাফিকব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করা, ফিটনেসবিহীন গাড়িকে পারমিট না দেওয়া, চালকদের লাইসেন্স প্রদানে যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করা, সড়ক ও মহাসড়কগুলোকে ক্রমে সিসিটিভি-র আওতায় আনা এবং জনসাধারণকে সচেতন করা প্রভৃতি ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি বিমান পরিবহনকে আরও উৎসাহিত করা হবে। স্বল্প খরচে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের চলমান প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। রাজধানী ঢাকার জনপরিবহন সমস্যার সমাধান ও যানজটমুক্ত করার লক্ষ্যে পাতাল রেল, মেট্রোরেল অথবা সার্কুলার রেলপথ এবং রাজধানীতে নাব্য ও প্রশস্থ নৌপথ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি করা হয়েছে।
এ ছাড়াও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে উন্নত করে আঞ্চলিক বিমানবন্দর হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার করা হয়েছে। যাতে সীমান্তবর্তী ভারতের ৭টি প্রদেশ এবং নেপাল ও ভুটান এই বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারে সে লক্ষ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও ট্রান্স এশিয়ান হাইওয়ে এবং ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে, বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল এবং বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক জোটের যোগাযোগ-ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্প্রসারিত হবে।
নৌপথ ও বন্দরকে গুরুত্ব দিয়ে ইশতোরে বলা হয়েছে, এ সময় যোগাযোগের ৮৫ শতাংশ হতো নৌপথে। দেশে সর্বমোট প্রায় ২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ রয়েছে। যার মাত্র ৬ হাজার কিলোমিটার পরিবহন কাজে ব্যবহার করা হয়, শুষ্ক মৌসুমে অর্ধেকে নেমে আসে। অভ্যন্তরীণ নৌপথের পুনরুদ্ধার ও সর্বোচ্চ ব্যবহার আবশ্যক। ইতোমধ্যে ২০০৯-১৫ সময়ে খনন করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ কিলোমিটার নৌপথ। সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৩টি নৌপথে খনন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৭০ কিলোমিটার নৌপথ এবং প্রায় ৩ হাজার একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে। মোংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথ খনন করে সুন্দরবন রক্ষার্থে নৌ-সংযোগ চালু করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোংলা বন্দরে লাভ হয়েছে ৯৫ কোটি টাকা। কিন্তু ২০০১-০৬ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় মোংলা বন্দরে ১১ দশমিক ৫ কোটি টাকা লোকসান হয়েছিল।
নির্বাচনি ইশতেহার চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর দুটিকে আধুনিকায়নসহ পটুয়াখালীতে পায়রা সমুদ্রবন্দর স্থাপন করার কথা তুলে ধরে লক্ষ্য ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে বলা হয়েছে, ব্যাপক খননের পরিকল্পনা হিসেবে আগামী মেয়াদে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খনন করা হবে। আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দরের সাথে অভ্যন্তরীণ নৌপথগুলোর সংযোগ স্থাপন করার মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি সুগম করা হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্যকে সহজতর করার লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে নৌপথ বাণিজ্য আরও বাড়িয়ে একে নেপাল-ভুটান পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হবে। ২০২৩ সালের মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দর স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ১৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বে-টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে বন্দরের সক্ষমতা ৪ গুণ বৃদ্ধি পাবে। ঢাকার চারপাশের ৪টি নদী এবং খালগুলোকে দূষণ ও দখলমুক্ত করে খননের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে নদীতীরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
সারাবাংলা/এনআর/এমআই
আরও পড়ুন:
আ.লীগের ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখার অনুরোধ
ব্লু-ইকোনমি অগ্রাধিকার পেয়েছে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে