Sunday 18 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তারুণ্যের চাওয়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, উন্নয়নের ধারা


২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৬:৫৬ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৮ ১০:২৭

।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত দেখতে চান তরুণরা। যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, উন্নয়নের অগ্রযাত্রা যেন থেমে না যায়— সে প্রত্যাশা তাদের। একইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তিকে ভোট না দেওয়ার পক্ষেও অবস্থান তাদের। তরুণদের কেউ কেউ বলছেন, তারা নৌকাতেই ভোট দেবেন, কেউ কেউ আবার যোগ্যতা বিচার করে ভোট দিতে চান নির্বাচনে। কেউ বলছেন, কেবল মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে ফায়দা লুটতে ব্যস্ত একটি দল। ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে কোনো কোনো তরুণের। ভোট দেওয়ার পর গণনায় কী হবে, সে শঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকে।

বিজ্ঞাপন

তবে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পর নতুন সরকারের কাছে সব তরুণের চাওয়া প্রায় একই। নতুন সরকার দেশের শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কার আনবে; বেকারত্ব দূর করতে থাকবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা; বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাড়বে মৌলিক গবেষণা; প্রসার ঘটবে কারিগরি শিক্ষার; সকল ক্ষেত্রে বন্ধ হবে দুর্নীতি; সংস্কার হবে আর্থিক খাতের; বাস্তবায়িত হবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নসম সব প্রত্যাশা— মোটা দাগে এমন চাওয়ার কথাই জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরুণ ভোটাররা।

দেশের মোট ভোটারের ২০ থেকে ২২ শতাংশ তরুণ ভোটার হিসেবে বিবেচিত। ভোট দেওয়া নিয়ে এই শ্রেণির উৎসাহ যেমন বেশি থাকে, তেমনি তরুণ ভোটাররা নির্বাচনি ফলেও ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ান বরাবরই। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমন তরুণ ভোটার প্রায় আড়াই কোটি। এর একটি বড় অংশই এবার প্রথমবারের মতো ভোট দিতে যাচ্ছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন। সেখানে কথা হয় নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরুণ ভোটার রাসেলুর রহমানের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্ত তারুণ্যবান্ধব সমাজ উপহার দেবে— আমরা এমন সরকার চাই। এই সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করবে না, শিক্ষার ক্ষেত্রে থাকবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।’

বিজ্ঞাপন

নির্বাচন কমিশনের দলীয়করণই সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় বাধা বলে মনে করেন এই তরুণ। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকবেন, তারা যদি দলীয় সমর্থক হন, নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা যদি দলীয় মতাদর্শ ধারণ করেন, তাহলে তো নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না।’ কেন্দ্র দখল, ভয়ভীতি দেখানো ও বিশৃঙ্খলাকে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অন্তরায় বলে মনে করেন অর্থনীতির এই ছাত্র। তার মতে, বর্তমান সরকারের উন্নয়ন আপাতদৃষ্টিতে বেশ ভালো। তবে সেবা নিতে গেলে এখনও ঘুষ দিতে হয়। ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে। ফলে আর্থিক খাতের সংস্কারে নজর দেওয়া উচিত বলে মনে করছেন তিনি। শিক্ষাসহ অন্যান্য খাতেও নীতিতেও পরিবর্তন চান এই শিক্ষার্থী। বলেন, বর্তমান সরকারের অনেকগুলো দুর্বলতা আছে। নতুন সরকার যেন সেগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে।

প্রথমবারের মতো ভোট দেবেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাজু আহমেদ। ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে তার মধ্যে রয়েছে উৎসাহ। তবে, বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে খানিকটা শঙ্কার কথা বলেন তিনি। তারপরও আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি।

সিলেটের মৌলভীবাজারের ভোটার রাজু সারাবাংলাকে বলেন, ‘সৎ, যোগ্য ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে ভোট দেবো।’ আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘দেশ বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম তাতে উৎসাহিত। কিন্তু একই সময়ে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি সেক্টরে দুর্নীতি। কেবল দুর্নীতির কারণে সরকারের অনেকগুলো ভালো কাজ ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। তারপরও উন্নয়নের স্বার্থেই আওয়ামী লীগকে ভোট দেবো।’ নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশার কথা জানিয়ে রাজু আরও বলেন, ‘যে সরকারই আসুক, তারা যেন দেশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখে। বিশ্ববদ্যালয়গুলোতে কারিগরি শিক্ষা ও মৌলিক গবেষণার বৃদ্ধি হোক— এটাই আমরা চাই।’

https://www.youtube.com/watch?v=pGc8NtMdg-4

প্রথম ভোট নিয়ে উচ্ছ্বসিত ঢাবির অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী অনয় চৌধুরি সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চাই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই আমার ভোট যাবে।’ রংপুরের ভোটার অনয় বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত বিএনপি যদি নির্বাচন থেকে সরে যায়, তবে তা কেউ ইতিবাচক হিসেবে নেবে না। দলটি নির্বাচনে না এলে প্রশ্ন থেকে যাবে। তাই আওয়ামী লীগের আরও ছাড় দেওয়া উচিত।’

নির্বাচন সুষ্ঠু হলে আওয়ামী লীগই ফের ক্ষমতায় আসবে বলে মনে করেন এই শিক্ষার্থী। অনয় চৌধুরি আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ১০ বছর ক্ষমতায় ছিল। যেভাবে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে, তাতে বলা যায় আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় আসবে। যদি কিছু আসন বিএনপি পেত, তাহলে সংসদে কার্যকর বিরোধী দল থাকত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কারণ, মাঠ পর্যায়ে দলটি শক্তিশালী। বহু নিবেদিত কর্মী আছে। সে হিসেবে প্রশ্ন থাকে, মাঠে আসলে বিএনপি কতটা টিকতে পারবে? কারণ, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে এগিয়ে আছে। তবে, নির্বাচনি মাঠে এত বেশি খেলা ভালো নয়।’

ঢাবি ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী সাদমান সাকিব বলেন, ‘ক্ষমতায় কে আসবে তা জনগণই নির্বাচন করবে। যেই আসুক সমস্যা নেই। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি নৌকাতেই ভোট দিবো।’ কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অন্য সরকার এলে দুই বছরের জন্য উন্নয়ন কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। এক সরকারের রেখে যাওয়া কাজ অন্য সরকারের আমলে শেষ না হওয়া বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কেউ একটি ব্রিজ করে গেল, পাশেই আরেকটি ব্রিজ। অথচ আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর কাজ চলছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকুক, সেটিই আমি চাই।’ পরবর্তী সরকারের কাছে এই শিক্ষার্থীর দাবি, যোগাযোগ ও রেলপথের আরও বেশি উন্নয়ন।

ঢাবির একই বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী আফিয়া তাসনিম ঊর্মি সারাবাংলাকে বলেন, ‘নতুন ভোটার হিসেবে আমার ভোট যেন আমি দিতে পারি, এটাই প্রথম চাওয়া। আগের বারের মতো যেন একজনের ভোট আরেকজন দিয়ে না যায়। নির্বাচন যেন সুষ্ঠু হয়। সব দল যেন অংশগ্রহণ করে এবং কেউ যেন নির্বাচন বয়কট না করে।’ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলকেই তিনি অন্তরায় বলে মনে করেন। তার প্রত্যাশা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে যারাই ক্ষমতায় আসবে, তারাই যেন জনগণের কথা মাথায় রাখে। উর্মি বলেন, ‘পক্ষ বিপক্ষ নয়, প্রার্থী যে ভালো হবে তাকেই ভোট দেবো, মার্কা দেখে নয়।’

গাজীপুর সাইনবোর্ডের বাসিন্দা তরুণ ভোটার সালিনা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভোটে যেন কারচুপি না হয়। আর ভোট দিলেই যে প্রোপারলি কাউন্ট হবে তা কে বলতে পারে?’ নির্বাচিত হয়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে সেই সরকারের কাছে তরুণ এই ভোটারের প্রত্যাশা শিক্ষার সংস্কার ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় যেন বেঁধে দেওয়া না হয়।

সালিনা আরও বলেন, ‘নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা সড়ক পথের নিরাপত্তা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। কোনো নেতার বিরুদ্ধে বললে যেন গুম হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা না থাকে। সবমিলিয়ে নিজের জানমাল ও ইজ্জতের নিরাপত্তা চাই।’

ভোট ভাবনা জানতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গেও কথা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোরশেদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমবারের ভোট, অন্য রকমের উৎসাহ।’ প্রার্থীদের বিষয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘নির্বাচিত হওয়ার পর প্রার্থীরা যেন মানুষের পাশে থেকে থেকে দেশের কাজ করেন।’ রাজশাহীর বেয়ালিয়ার এই ভোটার এক প্রশ্নের উত্তরে সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবশ্যই, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চাই। তাই নৌকায় ভোট দেবো। এছাড়া আমার এলাকাটি আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগের প্রার্থী যদি নির্বাচিত হয়, তবে বেশি বেশি অনুদান পাওয়া যাবে। এলাকার আরও বেশি উন্নয়ন হবে। ফলে আমি উন্নয়নের স্বার্থেই আওয়ামী লীগকে ভোট দেবো।’

বিশ্ববিদ্যালয়টির একই বিভাগের শিক্ষার্থী আবদুল মোমেন সজল বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই। ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার পথে যেন কেউ বাধা না দেয়।’ ভোটাধিকার প্রয়োগ ও নিজের ভোট গণনায় না আসা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে সজলের। সারাবাংলাকে সজল বলেন, ‘ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার পথে বাধা আসতে পারে। আর যদি ভোট দিয়েই ফেলি, তাহলে আমার ভোট কি কাউন্ট হবে? যদি তা না হয়, তাহলে ভোট দিয়ে লাভ কী!’ নির্বাচিত সরকারের কাছে তার প্রত্যাশা— উন্নয়নের পাশাপাশি দেশে যেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও থাকে। যেন বজায় থাকে গণতান্ত্রিক অধিকার।’

ভোট ভাবনা জানতে চাইলে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থী প্রগল্ভা প্রিয়দর্শিনী সারাবাংলাকে বলেন, “দেশের রাজনীতির প্রতি ভরসা নেই। কোনো প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ইচ্ছা নেই। বরং ‘না’ ভোটের প্রতিই আমার ভরসা বেশি।” এই শিক্ষার্থীর মতে, পেশি শক্তির প্রয়োগ ও অন্ধ ভক্ত-সমর্থকই শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের অন্তরায়। প্রিয়দর্শিনী বলেন, ‘দলের অন্ধ ভক্ত সমর্থক না হয়ে দেশের হওয়া উচিৎ ছিল। আর এই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অন্ধ ভক্ত-সমর্থকই সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বড় বাধা।’ ধানমন্ডির এই বাসিন্দা আরও বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশা নেই। তবে নতুন মুখ দেখতে চাই। দেশকে উদ্ধার করার জন্য নতুন কোনো মুখ আসুক। নতুন কোনো দল, নতুন চিন্তার কোনো প্রতিনিধি।’

সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের প্রত্যাশার কথা জানিয়ে মিরপুর বাংলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. রবিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবো। কারণ বিএনপির মধ্যে অত্যাচারী ও সহিংস মনোভাব রয়েছে। আগের নির্বাচনেও অনেক সহিংসতা হয়েছে। নতুন করে আবারও সেই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।’ রবিন আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকার যে উন্নয়ন করেছে, অন্য কোনো সরকার কখনওই তা করতে পারেনি। আর ভিন্ন কোনো সরকার এলে চলমান সব কাজ থেমে যাবে। দেশের স্বার্থেই সরকারের ধারাবাহিকতা দরকার। আর এ কারণেই আমি আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট দেবো।’

তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী ও নেত্রকোনার ভোটার তানিতা সিদ্দিক প্রমি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে যেন কোনো ধরনের নির্বাচনি সহিংসতা না হয়— সেটাই আমরা চাই। আমরা সবাই সুখে ও শান্তিতে থাকতে চাই। শান্তিতে নিজের ভোট দিতে চাই। আর শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পর যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তাদের কাছেও শান্তি কাম্য।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর