Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘গণমাধ্যমকর্মীদের নীতিবিবর্জিত দলীয় সমর্থন পীড়াদায়ক’


২২ ডিসেম্বর ২০১৮ ২১:০২

।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: অনেক ক্ষেত্রে গণমাধ্যমকর্মীদের অন্ধ, নীতিবিবর্জিত দলীয় সমর্থন পীড়াদায়ক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারের নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকও কম থাকবে। তাই দেশীয় পর্যবেক্ষকদের নানা বিধিনিষেধের মধ্যে থাকতে হবে। এ কারণেই গণমাধ্যমকে জোড়ালো ভূমিকা রাখতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান এ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, দলীয় সমর্থন ও অন্ধ নীতিবিবর্জিত দলীয় সমর্থনে ইতি টানা জরুরি। ‘প্রফেশনাল ইন্টিগ্রিটি অব মিডিয়া’ ফিরে আসাটা খুব দরকার।

শনিবার (২২ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্টাডিজ মিলনায়তনে ‘নির্বাচন ও গণমাধ্যম’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে হোসেন জিল্লুর এসব কথা বলেন। সিজিএস (সেন্টার ফর গভর্নেন্স ফর ফেয়ার ইলেকশন)-এর আয়োজনে অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিউ এজ পত্রিকার সম্পাদক নুরুল কবির। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সিজিএস নির্বাহী পরিচালক হোসেন জিল্লুর রহমান। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, রাজনীতিবিদ, সাবেক আমলা, শিক্ষক, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা এতে অংশ নেন।

সিজিএস চেয়ারম্যান অধ্যাপক আতাউর রহমানের সভাপতিত্বে গোলটেবিলে আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা কমিটি সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হূমায়ুন, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান খান দুদু, দৈনিক দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক রেজওয়ান সিদ্দিকী, ভারতভিত্তিক সাউথ এশিয়ান মনিটরের নির্বাহী সম্পাদক চন্দন নন্দী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লা, সিজিএস ভাইস চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীসহ অন্যরা।

হোসেন জিল্লুর বলেন, ভোটের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে আশঙ্কা ও উদ্বেগ ঘিরে আছে। পর্যবেক্ষকদের কর্মকাণ্ডে নানা সীমাবদ্ধতা দেওয়ায় এবারের নির্বাচনে গণমাধ্যমকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

তিনি বলেন, আইনি প্রক্রিয়ায় যেনতেনভাবে একটি নির্বাচন হয়ে যেতেই পারে, যেমনটা হয়েছে ২০১৪ সালে। তাই কেবল আইনি বৈধতা নয়, নির্বাচনের নৈতিক বৈধতাও থাকতে হবে।

নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগের কারণগুলো বায়বীয় নয়। বাস্তবতর নিরিখেই উদ্বেগ এসেছে। নির্বাচনের প্রার্থিতা বাছাইয়ের পর্যায়ে যে উৎসব দেখা গিয়েছিল, তাতে ভাটা দেখা যাচ্ছে। সরকারি দল একপেশে মাঠ দখলে রেখেছে। বিরোধী পক্ষ মাঠে চাপে আছে।

মূল প্রবন্ধে নুরুল কবির বলেন, আগের নির্বাচনগুলোর আগে নির্বাচন কমিশন (ইসি) প্রশাসনে রদবদল করত। এবার সেটি না হওয়ায় সরকারের সাজানো প্রশাসনের মাধ্যমে নির্বাচন হচ্ছে। প্রতিদিন বিরোধীদলের তিন থেকে চারশ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এরা লিডিং অ্যাক্টিভিস্ট, যারা দলের হয়ে মানুষকে সংগঠিত করবে। কারও কারও বিরুদ্ধে ১০ থেকে ২১০টি পর্যন্ত মামলা রয়েছে। যাদের কোনো মামলায় জামিন হয়নি বা জামিন কবে বাতিল হয়েছে, তা তারা না জানায় এখনও জেলের মধ্যেই আছেন। এতে অনেকের মতো একজন নির্বাচন কমিশনার পর্যন্ত বিব্রত হয়েছেন।

নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরেও পুলিশ কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিষয়টি উল্লেখ করে নুরুল কবির বলেন, ‘নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর গত দু’সপ্তাহে প্রশাসনে পদোন্নতি হয়েছে। এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’

নুরুল কবির বলেন, সাংবাদিক সমাজ দু’টি শিবিরে বিভক্ত। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা বিষয়ক মিডিয়া উপকমিটিতে থাকা সাংবাদিকরা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে সভা করেছেন। সাংবাদিকরা আছেন বিএনপির সঙ্গেও। কিন্তু এমন হলে সাংবাদিকদের সমালোচনার জায়গা থাকে না। টেলিভিশন মালিকেরা কোনো না কোনো দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় সরকারের প্রকৃত সমালোচনা করা সম্ভব হয় না। এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে, নিজেদের মধ্যে সেলফ সেন্সরশিপ চলে আসে। এ অবস্থা সাংবাদিক, রাজনীতিক কারও জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না।

নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, সরকারের বর্তমান অবস্থানে যাওয়ার পেছনে ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না করার দায় রয়েছে। ইসি গণমাধ্যমকে নানা বিধিনিষেধ দিচ্ছে, সাংবাদিক নেতারা এ বিষয়ে ইসির সঙ্গে আলোচনা করতে পারতেন। কিন্তু এখন ‘হোয়াট আর ইউ ডুয়িং— এই প্রশ্ন করার মানুষ নেই। কিন্তু আমাদের সময়ে এসেছিলেন। কিন্তু এখন কেন আপনারা যাচ্ছেন না?

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ইকতেদার আহমেদ বলেন, ইসি প্রার্থিতা বৈধ করার পরে উচ্চ আদালত বাতিল করছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) বলা আছে, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর ইসি কোনো প্রার্থিতা বাতিল করলে নতুন করে নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করতে হবে।

তিনি বলেন, প্রার্থিতার বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত। এরপর কোনো প্রতিকার চাইলে ইসির ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে। উচ্চ আদালত এমন কোনো আদেশ দিতে পারে না যাতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে কাউকে সরে যেতে হয়।

বাংলাদেশের গণতন্ত্রে আপাতদৃষ্টিতে সব আছে, কিন্তু ভেতরটা শুকিয়ে গেছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানই বিকশিত হতে পারেনি। দেশের গণমাধ্যমও নাবালক রয়ে গেছে। সাবালকত্বের জন্য প্রয়োজনীয় পেশাদারিত্ব দেশের গণমাধ্যম অর্জন করতে পারেনি। পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য পেশাদার সাংবাদিক প্রয়োজন।

দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, নির্বাচনে একদলের প্রচার ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। প্রতিযোগিতার পরিবেশ অনুপস্থিত। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে চান, কিন্তু সে পরিস্থিতি নেই। কর্তৃত্ববাদী শাসনের ক্রসরোডে ছিলাম, আগামী নির্বাচনের পরে কর্তৃত্ববাদী শাসনে যাব— এটাই বাস্তবতা।

তিনি বলেন, সেলফ সেন্সরশিপে গণমাধ্যম কাবু। সাংবাদিকেরা চাইলে তিন দিনের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। মানুষের মনে এখন প্রশ্ন, তারা ভোট দিতে যেতে পারবে কি না। মানুষ কিন্তু ভোট দিতে চায়, পরিবর্তন চায়। সে উপায় খুঁজতে হবে। কিন্তু তা হয় না। কারণ সাংবাদিকেরা দলীয় সুবিধা নেওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতায় আছেন।

মানুষ আমাদের গালি দেয়, হতাশার কথা বলে। এই পরিস্থিতির জন্য আমরা কম দায়ী নই উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাই আমাদের পরিচয় ঠিক করতে হবে, আত্মপরিচয় খুঁজে নিতে হবে।

অন্যদিকে, মূলধারার গণমাধ্যমকে যত চাপে রাখা হবে, ভিন্ন ধারা, ভুয়া সংবাদ তত ছড়িয়ে যাবে এবং গুজব, ভুয়া সংবাদের বিস্তারের কারণে মূলধারার গণমাধ্যম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান। তিনি বলেন, গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ফেসবুক যে অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করে দিয়েছে, সেগুলোর আঙুল সরকারের দিকেও তোলা হয়েছে। আমরা এখন একটি ওয়েক-আপ কলের মধ্যে রয়েছি।

বিএনপিপন্থী সংগঠন জি-৯-এর সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এবারের নির্বাচনে দু’টি শব্দ জনপ্রিয় হয়েছে— ‘ফেয়ার ইলেকশন’ ও ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’। যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে করে ইলেকশন কতটা ফেয়ার হবে বোঝা মুশকিল। কিন্তু একটা গ্রুপের জন্য এটা ‘লাভলি’ হতে পারে।

তিনি বলেন, ‘সংবাদ মাধ্যমের মালিকেরা কোনো না কোনো দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সাংবাদিকেরা অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগার, জাতীয়তাবাদীদের থেকে বেশি জাতীয়তাবাদী। নির্বাচনের আগে হঠাৎ এই অভ্যাস থেকে তারা বের হয়ে আসবেন— এটা প্রত্যাশা করছি না।’

সারাবাংলা/জেএ/টিআর


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর