জিপিএ-৫ বনাম মানসিক চাপ ও সামাজিক সম্মান!
২৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ১৭:২১
।। জান্নাতুল ফেরদৌসী।।
‘তোর মেয়ের রেজাল্ট কী? আমার ছেলে জিপিএ-৫ পেয়েছে! মান-সম্মান রক্ষা হয়েছে।’
ফোনে এক বন্ধুর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠের জবাবে জানালাম, আমার মেয়েও পেয়েছে। ঠিক তখনই মাথায় এলো, আমার মেয়ের তো জিপিএ-৫ পাওয়ার কথা ছিল না। কোচিং করেনি, টিচারদের বাসায় দৌড়ায়নি, এমনকি স্কুল টেস্টের রেজাল্টে কোনোমতে টেনেটুনে পাস। তাই জিপিএ-৫ এর প্রত্যাশাও ছিল না।
কিন্তু এই যে চারপাশে ‘জিপিএ-৫’-এর ‘গর্ব’— এটা থেকে বঞ্চিত হলে আমি, আমার মেয়ে বা তার বাবা-নানু-দাদুরা কি সামাজিক মর্যাদায় পিছিয়ে যেতাম আজ?
কী ক্ষতি হতো এ বছর পিইসিতে ৩ লাখ ৬৮ হাজার ১৯৩ জন জিপিএ-৫ পাওয়ার দলে আমার মেয়ে না থাকলে? ওর কি খুব সম্মানহানি হতো? ও কি বন্ধুদের কাছে ছোট হয়ে যেত? স্কুলের ভাবিদের কাছে কি ওর মা ছোট হয়ে যেত! আমার চারপাশের বেশিরভাগ মায়েদের ভাবনার গণ্ডিটাই কিন্তু এখন এমন।
জিপিএ-৫ পাওয়ার জন্য অভিভাবকদের দৌড়ের প্রতিযোগিতায় আমি বরাবরই পিছিয়ে ছিলাম বা থাকতে চাইতাম। তাই মেয়েকে কোচিং (আমার কাছে টর্চার সেল) না করানোর প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। কিন্তু খেসারত হিসেব প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষার রেজাল্টের পর ’প্যারেন্টস মিটিং’য়ে জানানো হলো— ‘মেয়ের রেজাল্ট ভয়ঙ্কর খারাপ, অভিভাবকরা এত উদাসীন হলে চলবে না, জিপিএ-৫ ফসকে যাবে।’
ক্লাসেই ইংরেজির শিক্ষক আমার মেয়েকে ধমকিয়ে জানালেন, ‘তোর মাকে বলিস তোর কথা একটু ভাবতে। আমার কাছে আরও ৪/৫ জনকে ম্যানেজ করে একটা ব্যাচ করে পাঠাতে বলিস। নইলে তো ফেল করবি!’
কিন্তু সেই মিটিংয়ে আমাকে সুযোগ দেওয়া হয়নি এটা বলতে যে, আপনাদের স্কুল (সরকারি) বছরের ৭ মাস বন্ধ থাকে। আমার মেয়ের স্কুলের খাতায় কখনও আপনাদের শেখানো কোনো অংক বা নোট থাকে না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে শেষ সময়ে পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হলেও আপনারা ‘প্রশ্নপত্র তৈরি করে ফেলেছি আগেই’ জানিয়ে পরীক্ষা নেন পুরনো পদ্ধতিতেই।
যাহোক আমাদের সন্তান, তাই দায় পুরোটাই নিজেদের। যে কারণে ক্লাস শিক্ষকদের হুমকি-ধমকির পরই বন্ধ হয়ে গেল আমার মেয়ের গান-কবিতার ক্লাস! শুরু হলো রাত ১০টায় মায়ের অফিস শেষে বাবা বাসায় ফিরে রাত ১২টা পর্যন্ত পড়ানোর ব্যাপক কর্মযজ্ঞ! ফল হিসেবে পেলাম জিপিএ-৫, আর ‘মেয়ের অস্বাভাবিকতা।’
সচেতন মা বলেই হয়তো এই মানসিক অসংলগ্নতাকে গুরুত্ব দিচ্ছি। তাকে আবার তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। কিন্তু আমার ছোট্ট মেয়েটার কাছে আমি এখন অপরাধী। ওর স্বাভাবিক বয়সসুলভ জায়গা থেকে ওকে উপড়ে ফেলার জন্য তো আমরা নিশ্চিত অপরাধী। সামাজিক সম্মান রক্ষার চাপে পড়ে শেষ মুহূর্তে জিপিএ-৫-এর জন্য যুদ্ধে নামার মিছিলে শরিক হওয়ার জন্য নিজেকে ধিক্কার দেই মাঝে মাঝে। পিইসি পরীক্ষা ক্ষুদেদের বড় ধরনের ‘অহেতুক’ মানসিক চাপ বলেই আমি মনে করি।
অতি সচেতন অভিভাবক ও শিক্ষকদের বলতে চাই, প্রাথমিক সমাপনীর অতি সহজ প্রশ্নপ্রত্র দেখে নিশ্চয় আপনাদের উপলব্ধি হয়েছে— এটি খুবই সহজ সাধারণ একটি পরীক্ষা। গ্রামের ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া থেকে রক্ষা করতেই সরকারের এই উদ্যোগ।
শিক্ষকদের বলতে চাই, আপনারা কোচিং বাণিজ্যের ফাঁদে ফেলতে ক্লাসে যেসব গাদা গাদা ফটোকপির শিট পড়ান, তা কোনো কাজেই আসে না। এত কঠিন কঠিন সিলেবাস আর স্কুল পরীক্ষায় কঠিন কঠিন প্রশ্নপত্র তৈরি করে, রেজাল্ট খারাপ করিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মানসিক চাপে ফেলে তাদের বিভ্রান্ত করা বন্ধ করুন, প্লিজ।
আমাদের শিশুদের স্বাভাবিকভাবে বড় হতে দিন। তাদের জন্য আমরা জিপিএ-৫ চাই না। একটা বড় খেলার মাঠ চাই। বিকেলে কোচিংয়ে পাঠাতে চাই না, ওদের মাঠে বা ছাদে পাঠাতে চাই। স্কুলের পড়া বাসায় প্রাইভেট টিউটর রেখে বোঝাতে বা শেখাতে চাই না। ওরা গলা ছেড়ে গান করুক, প্রজাপতির মতো ডানা মেলে নিশ্চিন্তে একটু ঘুরে বেড়াক। ‘মা তুমি ভালো না, শুধু পড়তে বলো’— এটা না বলে বলুক, ‘মা, আসো গল্প করি, কবিতা বা গল্পের বই পড়ি। আসো দু’জনে মিলে গান করি।’
আমরা ভীষণ ক্লান্ত। এবার কোচিং আর জিপিএ-৫ পাওয়ার হাত থেকে আমাদের রেহাই দিন, প্লিজ!
লেখক: বার্তা সম্পাদক, সারাবাংলা ডটনেট