নায়ক ত্রয়ী বনাম গায়িকা জুটি
২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ২১:২৮
।। তুহিন সাইফুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহের হিড়িক পড়ে যায়। মনোনয়ন ফরম সংগ্রহকারীদের তালিকায় শোবিজ জগতের তারকাদের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন অর্ধ শতাধিক তারকা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এসব দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন মাত্র পাঁচ জন।
আওয়ামী লীগ থেকে নৌকা প্রতীকে এবার নির্বাচন করছেন এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর ও চিত্রনায়ক আকবর হোসেন পাঠান, ওরফে নায়ক ফারুক। অন্যদিকে, বিএনপি থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়ছেন রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা ও বেবি নাজনীন। আর লাঙ্গল প্রতীকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়েছেন চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ, ওরফে সোহেল রানা।
পাঁচ তারকা প্রার্থীর মধ্যে নির্বাচনি অভিজ্ঞতায় সবার চেয়ে এগিয়ে আসাদুজ্জান নূর। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও তিনটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তিনি। বাকি চার জনই প্রথমবারের মতো নেমেছেন নির্বাচনের লড়াইয়ে।
‘বাকের ভাই’ খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে লড়ছেন নীলফামারী-২ আসন থেকে। জেলা সদরের এই আসন থেকে ২০০১ সাল থেকেই জিতে আসছেন তিনি। ৩ লাখ ১১ হাজার ৬৯৯ জন ভোটারের এই আসনে এবারও শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে বর্তমান সরকারের এই সংস্কৃতিমন্ত্রীর।
আসনটিতে নূরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ধানের শীষ প্রতীকের মনিরুজ্জামান মন্টু। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত থেকে দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে নূরের কাছে বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। এবার নির্বাচন কমিশন থেকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় বিএনপিতে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি।
ঢাকা-১৭ আসনে নৌকা নিয়ে নির্বাচনি লড়াইয়ে নেমেছেন বাংলা চলচ্চিত্র জগতে ‘মিঞা ভাই’ নামে পরিচিত আকবর হোসেন পাঠান, ওরফে ফারুক। তার এই আসনটিকে এবারের সংসদ নির্বাচনের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ একটি আসন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই আসনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হলেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদও লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী এই আসনে। যদিও সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এরশাদ জানিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে বোন মনে করেন বলে তার মনোনীত প্রার্থীর জন্য আসনটি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
এদিকে, এই আসনে ধানের শীষ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারমান আন্দালিভ রহমান পার্থ। আবার সাবেক বিএনপি সরকারের মন্ত্রী ও তৃণমূল বিএনপির প্রধান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাও লড়ছেন এই আসনে। অবশ্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) তৃণমূল বিএনপির নিবন্ধন না থাকায় তিনি সিংহ প্রতীকে লড়ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। শুধু তাই নয়, এই আসন থেকে সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনে মহাজোট থেকে মনোনীত হয়ে বিজয়ী হয়ে আসা বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের (বিএনএফ) চেয়ারম্যান এস এম আবুল কালাম আজাদও টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে লড়ছেন এই আসন থেকে।
তাই এরশাদ শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়ালেও এই আসনে ফারুকের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের সবাইই ‘প্রবল প্রতিপক্ষ’। এর মধ্যে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, আন্দালিভ রহমান পার্থ ও আবুল কালাম আজাদ— প্রত্যেকেরই সংসদে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। যদিও আবুল কালাম ছাড়া বাকি দু’জনই এর আগে অন্য আসন থেকে নির্বাচন করেছেন। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানী নিয়ে গঠিত এই আসনে তারা এবারই লড়ছেন প্রথমবারের মতো।
৩ লাখ ১৩ হাজার ৯৯৮ জন ভোটারের ঢাকা-১৭ আসনটিতে ফারুক প্রচারণায় ঘাটতি রাখেননি। গুলশান-২-এ এক জনসভায় দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও তার পক্ষে ভোট চেয়েছেন। তাই এই আসন থেকেই সংসদে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন নায়ক ফারুক।
চিত্রনায়ক মাসুদ রানা, ওরফে সোহেল রানা লড়ছেন বরিশাল-২ আসন থেকে। জাতীয় পার্টির এই প্রার্থীর প্রতীক লাঙ্গল। অবশ্য এই আসনে লাঙ্গল প্রতীকে তিনি মহাজোটের প্রার্থী নন। বরং মহাজোটের পক্ষ থেকে নৌকা প্রতীকে এই আসনে প্রার্থী আওয়ামী লীগের শাহে আলম। তিনিও এই প্রথম নেমেছেন নির্বাচনের লড়াইয়ে। আর বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাওয়া সরদার শরফুদ্দিন আহমেদ এর আগে একবার নির্বাচনে অংশ নিলেও জিততে পারেননি। সেই অর্থে ৩ লাখ ২ হাজার ৫৭১ ভোটারের এই আসনে তিন জনই অনেকটা ‘আনকোড়া’ প্রার্থী।
তিন অভিনয় শিল্পীর বাইরে শোবিজ জগতের আরও দুই তারকা এবারের নির্বাচনে লড়ছেন বিএনপির প্রার্থী হিসেবে, তারা দু’জনেই গায়িকা। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছেন রুমানা মোর্শেদ কনকচাঁপা। এই আসনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের হেভিওয়েট প্রার্থী বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। কনকচাঁপার এটি প্রথম নির্বাচন হলেও মোহাম্মদ নাসিম সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন আসন থেকে আট বার নির্বাচন করে জিতেছেন পাঁচ বার। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে চারবার নির্বাচন করে একবারও হারেননি তিনি।
৩ লাখ ৪৫ হাজার ৬৭৬ জন ভোটারের এই আসনে মনোনয়ন পেলেও অবশ্য ভোটের মাঠে কনকচাঁপার উপস্থিতি চোখে পড়েনি। স্থানীয় ভোটার ও বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, পোস্টার লাগানো থেকে শুরু করে কোনো ধরনের প্রচারণাতেই দেখা যায়নি তাকে। যদিও কনকচাঁপা বলছেন, নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কায় ভোটের মাঠে নামতে পারেননি তিনি। সেই অর্থে, এবারের নির্বাচনে এক অসম প্রতিদ্বনিন্দ্বিতাতেই নেমেছেন কনকচাঁপা।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির আরেক প্রার্থী বেবী নাজনীন। নীলফামারী-৪ আসনে দল থেকে মনোনয়ন ফরম কিনলেও অবশ্য প্রাথমিকভাবে মনোনয়নই পাননি তিনি। পরে হাইকোর্টের রায়ে ধানের শীষ প্রতীকে ওই আসনের প্রার্থী আমজাদ হোসেন সরকারের প্রার্থিতা বাতিল হওয়ায় ভাগ্যের শিঁকে ছিড়ে তার। ৩ লাখ ৭১ হাজার ৯৭৩ জন ভোটারের এই আসনে শেষ পর্যন্ত কোন প্রতীকে তিনি নির্বাচন করবেন, তা এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।
এদিকে, নীলফামারী-৪ আসনে নৌকার কোনো প্রার্থী না থাকলেও মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে লাঙ্গল প্রতীকে লড়ছেন আহসান আদেলুর রহমান। বেবি নাজনীনের মতো তারও এটিই প্রথম নির্বাচন। শেষ সময়ে প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ায় বেবি নাজনীন নিজের পক্ষে খুব একটা প্রচারণা না চালাতে পারলেও আশা করছেন, সংসদে তিনিই যাবেন।
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর শুরু হচ্ছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। এদিনই ১ হাজার ৮৬১ জন প্রার্থীর মধ্য থেকে তিনশ জনকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করবেন ভোটাররা। তবে এত প্রার্থীর ভিড়ে ফারুক-নূররা আলাদা। কারণ জনসেবার করার স্বপ্ন নিয়েই তারকা জগত থেকে মানুষের কাছাকাছি নেমে এসেছেন তারা। নির্বাচনের ফলে তাদের অবস্থান কোথায় দাঁড়ায়, তা নিশ্চয় কৌতূহল নিয়ে সবাই খেয়াল করবেন।
সারাবাংলা/টিএস/টিআর