।। স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: সব দলের অংশগ্রহণে সকাল ৮টায় শুরু হয়েছে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ। বিরতিহীনভাবে এই ভোটগ্রহণ চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত।
ভোট উপলক্ষে আগেই সব প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রতিটি জেলার কেন্দ্রে কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে নির্বাচনি সামগ্রী। নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। কেন্দ্রগুলোতে সেনাবাহিনীর টহল, বিজিবি ও পুলিশের উপস্থিতি রয়েছে।
ভোট উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৭টা থেকে বিভিন্ন কেন্দ্রে আসতে শুরু করেন ভোটাররা। কেন্দ্রগুলোয় ভোটারদের ছোট ছোট লাইন দেখা গেছে। তবে শীতের সকাল হওয়ায় ভোটারদের উপস্থিতি তুলনামূলক কম। এর আগে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোয় নির্বাচনি কর্মকর্তারা সকাল ৭টায় এসে পৌঁছান।
এবারের নির্বাচনটি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রথম নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে। এছাড়া এই নির্বাচন পুরোপুরি অংশগ্রহণমূলক। ফলে ব্যালট-বাক্সের মাধ্যমে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোকে।
শনিবার (২৯ ডিসেম্বর) দুপুরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা এক সংবাদ সম্মেলনে ভয়-ভীতিতে নতিস্বীকার না করার দেশবাসীর প্রতি ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে তিনি কোনো এজেন্টের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ না থাকলে তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়ার নির্দেশ দেন পুলিশকে।
সিইসি বলেন, ‘নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত সব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। আপনাদের কারণে যাতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।’
নির্বাচনের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি নির্দেশ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো সহিংস অপরাধ সংগঠিত হলে বা নাশকতামূলক অবস্থান সৃষ্টি করলে কঠোর হাতে দমন করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছি।
এদিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও ভোটারদের নির্ভয়ে ভোট দিতে কেন্দ্রে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি ভোট গণনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রে অবস্থানের জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনও ভোটারদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ভোট দিতে। পাশাপাশি ভোট কেন্দ্র পাহারা দিয়ে রাখার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এবার ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হবে বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
ভোটারদের লাইন
নাখালপাড়া প্রাইমারি স্কুলে ভোট শুরুর এক ঘণ্টা আগেই লাইনে দাঁড়ান অনেকেই। তাদের মধ্যে প্রবীণ ও নারী ভোটার বেশি।
নাখালপাড়ার বাসিন্দা আলী হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, এক ঘণ্টা যাবত লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। দীর্ঘদিন পর ভোট উৎসবে অংশ নিয়ে তিনি তার ভালো লাগার অনুভূতি জানান।
প্রসঙ্গত, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১২ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জয়ী হয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। ফলে দীর্ঘদিন পর ভোট দেওয়া নিয়ে এ আসনের সব ভোটারদের মধ্যেই উৎসাহ আর উদ্দীপনা রয়েছে।
শাহীনবাগের সিভিল অ্যাভিয়েশনের চিত্রও প্রায় একই। ভোট দেওয়ার জন্য নারী পুরুষের ছোট বড় লাইন রয়েছে। সেখানে শাহীনবাগের বাসিন্দা মুহাম্মদ আব্দুল মান্নান খান (৬৮) সারাবাংলাকে বলেন, তেমন লাইন নেই। ৫ থেকে ৬ মিনিট হলো লাইনে দাঁড়িয়েছি।
ভোট দেওয়া শেষে আরজতপাড়ার বাসিন্দা আব্দুর রউফ (৭০) বলছিলেন, খুবই সুন্দর পরিবেশে ভোট দিয়েছি। সেখানে ভোট দেয়া আরজতপাড়া গৃহিণী কোহিনুর (৪০) বলছিলেন, গেলাম আর আসলাম। ভোট দিয়ে ফেলেছি।
তরুণ ভোটার ওয়াসিম সাজ্জাদ বলছিলেন, সকাল সকাল ভোট দিতে চলে এসেছি। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেওয়ার আনন্দই অন্যরকম।
ঢাকা-১৫ আসনের মণিপুর স্কুল কেন্দ্রেও সকাল ৮টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু হয়।
এই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা পারুল (৫০) বলেন, ‘গতবার আমি এই কেন্দ্রে প্রথম ভোট দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার আমি একটু পেছনে পড়ে গেছি।’
নির্বাচনে প্রার্থীর সংখ্যা
এবার ৩০০ আসনের পরিবর্তে ২৯৯টি আসনে ভোটগ্রহণ চলবে। গাইবান্ধা-৩ আসনে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে ভোটগ্রহণ পিছিয়ে ২৭ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে। ২৯৯ আসনে ১ হাজার ৮৬১ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এরমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে ১ হাজার ৭৩৩ জন এবং অবশিষ্ট ১২৮ জন স্বতন্ত্র হিসেবে অংশ নিচ্ছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইসিতে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের সবগুলো দলই অংশ নিয়েছে।
নির্বাচনে মোট ভোটার, কেন্দ্র ও ভোট কক্ষের সংখ্যা
একাদশ সংসদ নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৫ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ জন, মহিলা ভোটার ৫ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ জন। এর মধ্যে নতুন প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ ভোটার প্রথমবারের মতো জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেবেন। নির্বাচনে মোট ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪০ হাজার ১৮৩ টি এবং ভোট কক্ষের সংখ্যা ২ লাখ ৭ হাজার হাজার ৩১২ টি।
৬টি সংসদীয় আসনে ইভিএমে ভোট
প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৬টি সংসদীয় আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার করে ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে। আসন ছয়টি হলো : ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ এবং সাতক্ষীরা-২। এসব আসনে ৪৮ জন প্রার্থী নির্বাচন অংশ নিয়েছেন। আসনগুলোতে মোট ভোটার ২১ লাখ ২৪ হাজার ৫৪৪ জন। পুরুষ ভোটার ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৫২জন, মহিলা ভোটার ১০ লাখ ৩৯ হাজার ৫০২ জন। এসব ভোটার ইলেকট্রোনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে (ইভিএম) ভোট দেবেন। আসনগুলোর ৮৪৫টি কেন্দ্রের ৫ হাজার ৩৮টি ভোট কক্ষে ইভিএম রয়েছে
নির্বাচনে ৩৮৯টি উপজেলায় ৪১৪ প্লাটুন সেনাবাহিনী থাকবে। ১৮টি উপজেলায় থাকবে নৌবাহিনীর ৪২ প্লাটুন। ১২ উপজেলায় থাকবে কোস্টগার্ড। বিজিবি থাকবে ৯৮৩ প্লাটুন এবং র্যাব থাকবে ৬০০ প্লাটুন। এছাড়াও মোবাইল ও স্টাইকিং ফোর্স থাকবে র্যাবসহ আরো ২ হাজার প্লাটুন। প্রতিটি প্লাটুনে থাকবে ৩০ জন।
নির্বাচনি কর্মকর্তার সংখ্যা
নির্বাচনে ঢাকা ও চট্রগ্রামে দুইজন বিভাগীয় কমিশনারসহ ৬৬ জন রিটানিং করমকর্তা থাকবেন। নির্বাচনে এক্সকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট থাকছে ১ হাজার ৩২৮ জন। এর মধ্যে আচরণবিধি প্রতিপালনের জন্য ৬৫২ জন এবং বাকি ৬৭৬ জন থাকবে অইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোবাইল ও স্টাইকিং ফোর্সের সঙ্গে নিয়োজিত।
এছাড়াও নির্বাচনে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকবে ৬৪০ জন। ইলেকট্রোরাল ইনকোয়ারি কমিটি রয়েছে ১২২টি (২৪৪ জন)। প্রিজাইডিং অফিসার ৪০ হাজার ১৮৩ জন। সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার ২ লাখ ৭ হাজার ৩১২ জন। প্রোলিং অফিসার থাকছে ৪ লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন।
নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক
এবারের সংসদ নির্বাচনে ৮১টি দেশি প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার ৯০০ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছন।
অন্যদিকে, বিদেশি ১০২ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যেবক্ষণ করবেন। এর মধ্যে ওআইসি, ফেম্ভোসা, এএইএ এবং কমনওেয়লথ থেকে ৩৮ জন পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। বিদেশি কূটনৈতিক ও বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা রয়েছেন ৬৪ জন।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ দূতাবাস/হাইকমিশন এবং বিদেশি সংস্থায় কর্মরত আরও ৬১ জন প্রতিনিধি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন। ফলে এবার সংসদ নির্বাচন দেশি-বিদেশি মোট ২৬ হাজার ৬৩ জন পর্যবেক্ষণ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবেন।
সারাবাংলা/জিএস/একে
আরও পড়ুন: আজ ভোট, ৮টা থেকে ৪টা