এক নজরে জাবিতে ঘটনাবহুল ২০১৮
২ জানুয়ারি ২০১৯ ১১:০৩
।। তহিদুল ইসলাম, জাবি করেসপন্ডেন্ট ।।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) দেশের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠ। তবে শিক্ষাঙ্গন হিসেবে শুধু শিক্ষা-গবেষণা কার্যক্রমই নয়, নানান ইতিবাচক-নেতিবাচক ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়টি সব সময় আলোচনায় থাকে। গত বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বছরের প্রথম দিকে বর্তমান উপাচার্যের দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণকে কেন্দ্র করে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের প্রকাশ্য বিভক্তি, শিক্ষকদের একটি অংশের লাগাতার আন্দোলন, শিক্ষকদের মধ্যে হাতাহাতি, ২৫ শিক্ষার্থীর জাপানে চাকরি লাভ, ছাত্রলীগের সংঘর্ষ, ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার প্রকল্প একনেকে অনুমোদন লাভ প্রভৃতি ঘটনায় বছরজুড়ে আলোচনায় ছিল ক্যাম্পাস।
উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের পুনঃনিয়োগ:
দেশের প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের প্রথম মেয়াদে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ মোটামুটি স্বাভাবিক ছিল। অনেকটাই স্থিতিশীল ছিল উপাচার্যের প্রথম মেয়াদের ৪ বছর। তবে উপাচার্যের দ্বিতীয় মেয়াদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে অস্থিতিশীলতা শুরু হয় জাহাঙ্গীরনগরে। এবছরের মার্চে প্রথম ৪ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ফেব্রুয়ারিতে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্যের দায়িত্বভার পান। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ্যে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা।
একটি পক্ষ উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের পক্ষে এবং অপর পক্ষ সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের পক্ষে। এরপর বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ তুলে উপাচার্যের পদত্যাগসহ কয়েকটি দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু করে উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকরা। উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকরা ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’ ব্যানারে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এতে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্যপন্থি ও উপাচার্যবিরোধী আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের বিরোধ এতটাই প্রকট হয়ে ওঠে যে, আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’ ভেঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধু-আদর্শের শিক্ষক পরিষদ’ নামে নতুন একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশ-শিক্ষার্থী সংঘর্ষ:
সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার সংস্কার দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হলে এর ছোঁয়া লাগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম দিকে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন, মিছিলের মত কর্মসূচি চলতে থাকে। এরই ধারাবাহিতায় গত ৯ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে। পরে দুপুরে যান চলাচল স্বাভাবিক করতে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর হামলা চালালে সংঘর্ষ শুরু হয়। ওইদিন এ সংঘর্ষে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়।
শিক্ষকদের দু’পক্ষের হাতাহাতি:
গত ১১ এপ্রিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ টি হলের প্রভোস্টকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে নতুন ৯ জন শিক্ষককে দায়িত্ব দেন। এ ঘটনার পর উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট -১৯৭৩, স্ট্যাটিউট ও সিন্ডিকেট পরিচালনা বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ধর্মঘট ডাকেন সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের অনুসারী শিক্ষকরা। পরে ১৭ এপ্রিল ভোরে পূর্বঘোষিত এই ধর্মঘটের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশমাইল এলাকায় পরিবহন ডিপোতে তালা ঝুলিয়ে দেয় উপাচার্যবিরোধী শিক্ষকরা। আর এই তালা দেওয়া ও তাতে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে ওইদিন ভোরে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের অনুসারী শিক্ষকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নিন্দার ঝড় ওঠে ক্যাম্পাস জুড়ে।
সম্পূরক বৃত্তির অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি :
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশক ধরে শিক্ষার্থীদেরকে মাসিক ১২৫ টাকা হারে সম্পূরক বৃত্তি দেয়া হত। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় আলোচনা-সমালোচনা হয়। শিক্ষার্থীরাও দীর্ঘদিন ধরে এ অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছিলেন। অবশেষে প্রায় দুই দশক পর গত জুনে সিন্ডিকেট সভায় এ অর্থের পরিমাণ ১২৫ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৫০০ টাকা করা হয়।
জাপানের খ্যাতনামা কোম্পানিগুলোতে ২৫ শিক্ষার্থীর চাকরি:
গত সেপ্টেম্বরে জাপানের নিশান, টয়োটা, মিৎসুবিসি, তোশিবা প্রভৃতি বিশ্বখ্যাত কয়েকটি কোম্পানিতে চাকরির জন্য মনোনীত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ শিক্ষার্থী।
ছাত্রলীগের দু’পক্ষের ভয়াবহ সংঘর্ষ :
এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করাকে কেন্দ্র করে গত ২ অক্টোবর দিবাগত রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল ও আল-বেরুনী হল শাখা ছাত্রলীগের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় উভয় পক্ষের অন্তত অর্ধশত নেতাকর্মী আহত হয়।
ভর্তি পরীক্ষা আধা ঘণ্টা পেছানো:
ছাত্রলীগের দুই পক্ষের ওই সংঘর্ষের ঘটনায় মীর মশাররফ হোসেন হল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বিচারের দাবিতে ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রে তালা ঝুলিয়ে দেয় আল-বেরুনী হল শাখা ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এতে ৩ অক্টোবরের সকল শিফটের ভর্তি পরীক্ষা নজিরবিহীন ভাবে আধাঘণ্টা পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বহিষ্কার নিয়ে তালবাহানা:
গত ২৪ সেপ্টেম্বর শাখা ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে মারধরের শিকার হন এক বহিরাগত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এক সাংবাদিক ও এক ছাত্রী। এ ঘটনায় বহিষ্কার নিয়ে তালবাহানা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ২ অক্টোবর প্রথমে ঘটনার সাথে জড়িত ৭জনকে সাময়িক বহিষ্কার করে অফিস আদেশ জারি করা হয়। পরে ওইদিন বিকেলে সংশোধিত আরেক অফিস আদেশে ৪ জনকে সাময়িক বহিষ্কারের কথা জানানো হয়। পরে ৪ অক্টোবর বহিষ্কৃত ৪ জনের বহিষ্কারাদেশও স্থগিত করা হয়। এতে সমালোচনার মুখে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপর ক্যাম্পাসে কর্মরত সাংবাদিকদের একটি অংশ অপরাধীদের বিচারের দাবিতে দুই প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করে। পরে এই ঘটনায় অভিযুক্তদের তিনজন পরবর্তীতে আরেকটি ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত থাকায় আজীবন বহিষ্কৃত হন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প একনেকে অনুমোদন:
গত ২৩ অক্টোবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বহুল প্রতীক্ষিত ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন’ শীর্ষক ১৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার প্রকল্পের অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। রাজধানীর শেরে বাংলা নগর এনইসি সম্মেলন কক্ষে একনেক চেয়ারপার্সন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে এ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়।
৫ ছিনতাইকারী শিক্ষার্থীকে ধরিয়ে দেয় ছাত্রলীগ:
গত ২৫ নভেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্সের এক শিক্ষার্থী ও তার বান্ধবীর কাছ থেকে ছিনতাইয়ের সময় ৫ শিক্ষার্থীকে আটক করে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় শাখা ছাত্রলীগ সর্বমহলে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। যদিও আটককৃত ছিনতাইকারীরাও ছাত্রলীগ কর্মী বলে পরিচিত। এ ঘটনায় অভিযুক্ত ৫ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করা হয়।
এসব ঘটনা ছাড়াও কতিপয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর ছিনতাই-কাণ্ড, বহিষ্কার, সিন্ডিকেট সভাকে ঘিরে শিক্ষকদের ধাক্কাধাক্কি, স্নাতকোত্তরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে উন্নয়ন ফি অর্থ ফেরৎ দেয়ার সিদ্ধান্ত প্রভৃতি ঘটনা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়। তবে নতুন বছরে পুরাতনকে পেছনে ফেলে শিক্ষা-গবেষণায় সাফল্যের পাশাপাশি অন্যান্য ক্ষেত্রে ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে এগিয়ে যাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এমন প্রত্যাশা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মো. নূরুল আলম বলেন, এ বছর যেসব নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছে, নতুন বছরে সেসব ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে হবে না বলে আমার বিশ্বাস। নতুন বছরে আমরা একটি সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ গড়ে তুলতে পারবো। এ বছর আমরা যে সাড়ে ১৪ শতকোটি টাকার প্রকল্প পেয়েছি, সে প্রকল্পের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারায় পাল্টে যাবে। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয় অনেক এগিয়ে যাবে।
সারাবাংলা/এনএইচ