Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ফের অশান্ত চীন-তাইওয়ান সম্পর্ক


৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০৮:৩২

।। জাহিদুর রহমান রিফাত, নিউজরুম এডিটর ।।

ঢাকা: ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ফের অশান্ত হয়ে উঠছে চীন ও তাইওয়ান সম্পর্ক। তাইওয়ানে যখন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি জোরদার হয়ে উঠছে সেই সময় চীন আবারও দাবি করছে, তাইওয়ান তাদের বিচ্ছিন্ন প্রদেশ। ভবিষ্যতে প্রদেশটি আবারও তাদের অংশ হবে।

তাইওয়ানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে নীতিমালা সংক্রান্ত বিবৃতির ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে দেওয়া এক ভাষণে বুধবার (২ ডিসেম্বর) চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, তাইওয়ান অবশ্যই চীনের অংশ হিসেবে থাকবে এবং তাদের এটা মেনে নেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ করার অধিকার রাখে চীন। জবাবে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তারা স্বায়ত্তশাসন চায়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্ধুরাষ্ট্র হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকেই তাইওয়ানের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে রেখেছে। এমতাবস্থায় চীন-তাইওয়ান বিরোধ তীব্র হলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও তীব্র হয়ে উঠছে।

ফিরে দেখা: চীন-তাইওয়ান বিরোধ

খ্রিস্টাব্দ ২৩৯ সাল। অস্ট্রোনেশীয় আদিবাসীরা আধুনিক চীনের দক্ষিণাঞ্চল থেকে তাইওয়ানে বসতি গড়ে তোলে। চীনের দাবি, তারা দ্বীপটিতে একটি অভিযাত্রী দল পাঠিয়েছিল। তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ দাবি করার জন্য এটাই চীনের অকাট্য প্রমাণ। তাইওয়ান বিতর্কে শুরু থেকেই চীন এই তথ্য উপস্থাপন করে আসছে।

এরপর ১৬২৪-৬১ সাল পর্যন্ত তাইওয়ানে উপনিবেশ গড়ে তোলে ডাচরা। পরবর্তীতে ১৬৮৩-১৮৯৫ সাল পর্যন্ত দ্বীপটি চীনের কিং রাজবংশের শাসনাধীন ছিল।

১৭ শতকের শুরুর দিকে চীনের নিপীড়ন ও দুর্দশা থেকে বাঁচতে দলে দলে তাইওয়ানের পথ ধরেন স্থানীয়া। তাদের বেশিরভাগই ছিল ফুইজান প্রদেশ থেকে পালানো হকলো চীনা বা গুয়াংডং থেকে পালানো হাক্কা। বর্তমানে তাইওয়ানের মোট জনসংখ্যার অধিকাংশই এই দুই অভিবাসী দলের বংশধর। ১৮৯৫ সালে প্রথম সিনো-জাপানি যুদ্ধে জাপানের জয়ের পর কিং রাজবংশের কাছ থেকে তাইওয়ানের দখলদারিত্ব পায় জাপান। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় ও আত্মসমর্পণের পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের অনুমতি নিয়ে তাইওয়ান শাসন শুরু করে চীন।

বিজ্ঞাপন

শাসন শুরু হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে কমিউনিস্ট নেতা মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে চীনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট চিয়াং কাই-শেকের পতন ঘটে। পরাজিত হয়ে চিয়াং ও তার কুয়োমিংতাং (কেএমটি) সরকারের বাকি সদস্যরা ১৯৪৯ সালে তাইওয়ানে পালিয়ে যায়। তাইওয়ানে পলানো চিয়াং ও তার অনুসারীদের বর্ণনা করা হয় মেইনল্যান্ড চাইনিজ হিসেবে। সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা ছিল ১৫ লাখ, যা তাইওয়ানের তৎকালীন মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ। কিন্তু তারপরও বহু বছর তাইওয়ানের রাজনীতিতে তাদের আধিপত্য ছিল। চিয়াং তার জীবদ্দশায় তাইওয়ানে কার্যকরভাবে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর চিয়াংয়ের ছেলে চিয়াং চিং-কুয়ো দ্বীপটির শাসন শুরু করে। কিন্তু ধীরে ধীরে স্থানীয়দের মধ্যে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে ওঠে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের বদলে জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের দাবি জোরালো হতে থাকে। ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অনুমোদন দিতে বাধ্য হয় চিং-কুয়ো।

চীন-তাইওয়ান সম্পর্কের উন্নতি

চীনের ‘গৃহযুদ্ধ’ শুরু হয়েছিল ১৯২৭ সালে। প্রথম দফায় ১৯৩৭ সালে কোনো ঘোষণা ছাড়াই যুদ্ধ স্থগিত হয়। এরপর দ্বিতীয় দফায় ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত চলে সেই গৃহযুদ্ধ। পরবর্তী কয়েক দশক বিরোধপূর্ণ সম্পর্কের পর আশির দশকে চীন ও তাইওয়ানের কিছুটা সহাবস্থান দেখা যায়। তবে ১৯৭৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে চীন নতুননীতি অবলম্বনের প্রস্তাব রাখে- যা ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ নামে পরিচিত। নতুন নীতিতে আরও খানিকটা উদারতা দেখিয়ে তাইওয়ানকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়। তবে শর্ত থাকে, ভৌগলিকভাবে তাইওয়ানকে চীনের অধীনস্ত হতে হবে। তাইওয়ান স্বাধীনতার প্রশ্নে আপস না করে চীনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। যদিও চীনে ভ্রমণ ও বিনিয়োগ বিষয়ক আইন শিথিল করে দেয় তাইওয়ান।

বিজ্ঞাপন

১৯৯১ সালে চীনের সঙ্গে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটেছে বলে ঘোষণা দেয় তাইওয়ান। সে সময় উভয়পক্ষের মধ্যে সীমিত আকারে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকও হয়। তবে চীনের দাবি, চীনা সরকার কোনো অবৈধ যোগাযোগ ঘটতে দেয়নি।

তাইওয়ানে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০০০ সালে। নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন চেন শুই-বিয়ান। তিনি প্রথম নন-কেএমটি শাসক হলেও নতুন করে নড়েচড়ে বসে চীন। কারণ চেন ছিলেন স্বাধীনতার পক্ষে। ২০০৪ সালে তিনি আবারও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০০৫ সালে চীন অপসারণবিরোধী আইন পাস করে। আইন অনুযায়ী, তাইওয়ান যদি চীন থেকে আলাদা হতে চায়, তাহলে বলপ্রয়োগ করতে পারবে চীন সরকার। ২০০৮ সালে কুয়োমিনতাং পার্টির চেয়ারম্যান মা ইং-জেও তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি চীনের সঙ্গে তাইওয়ানের সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করেন, কৌশলগতভাবে যা ছিল অর্থনৈতিক সমঝোতার। রাজনৈতিক সফলতার কারণে দ্বিতীয় মেয়াদেও তিনি নির্বাচিত হন।

সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞার কারণে ২০১৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি মা। তার বদলে কুয়োমিনতাং পার্টি থেকে লড়া এরিক চু’কে পরাজিত করেন ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির (ডিপিপি) সাই ইং-ওয়েন। ডিপিপিও তাইওয়ানের স্বাধীনতা চেয়েছিল। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন সাই। ১৯৭৯ সালের পর তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মধ্যে এটাই ছিল প্রথম আলোচনা।

ওয়েবসাইটে তাইওয়ানকে চীনের অংশ দেখাতে ২০১৮ সাল জুড়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাপ দেওয়া হয়। চীন সরকার জানায়, তাইওয়ানকে আলাদা করলে চীন বাণিজ্য নিষিদ্ধ করবে। গত নভেম্বরে আঞ্চলিক নির্বাচনে পরাজিত হন সাই’য়ের দল। বেইজিংয়ের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে দেখা অঞ্চলে ডিপিপির পরাজয় বেশ বড় ঘটনা হিসেবে প্রকাশ পায় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।

অমীমাংসিত বিতর্ক

তাইওয়ানকে স্বাধীনতা দেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্নে এখনও একমত হতে পারেননি বিশ্ব মোড়লরা। ১৯৪৯ সালে চিয়াং কাই-শেক’র চীন প্রজাতন্ত্র (আরওসি) সরকার তাইওয়ানে পালিয়ে যাওয়ার পর দাবি করে, তারা পুরো চীনের প্রতিনিধিত্ব করছে। চিয়াং সরকারের উদ্দেশ্য ছিল পুরো চীন ফের দখল করা। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার সরকার চীনের আসনেই উপবিষ্ট ছিল। অনেক পশ্চিমা দেশ চিয়াং সরকারকেই একমাত্র চীনা সরকারের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ তাদের কূটনৈতিক স্বীকৃতি বেইজিংয়ের দিকে নিয়ে যায়। জাতিসংঘ থেকে বাতিল হয়ে যায় আরওসি সরকার। এরপর থেকে আরওসি সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশের সংখ্যা কমতে থাকে। বর্তমানে এমন দেশের সংখ্যা ২০টির কাছাকাছি।

চীনের দাবি, তাইওয়ান তাদের বিচ্ছিন্ন প্রদেশ। প্রয়োজনে জোর করে হলেও প্রদেশটিকে চীনের অংশ করা হবে। তাইওয়ানও তার অবস্থানে অনড়। নেতাদের বক্তব্য, তাইওয়ান কোনো প্রদেশ নয়। এটি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। তাইওয়ানের নিজস্ব সংবিধান রয়েছে, রয়েছে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতা, সশস্ত্র বাহিনীতে প্রায় তিন লাখ সেনা রয়েছে।

তাইওয়ান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা

তাইওয়ানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধুপ্রতীম দেশ, বলা যেতে পারে একমাত্র মিত্র দেশ যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাইওয়ান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যদিও ১৯৭৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার তাইওয়ানের কূটনৈতিক স্বীকৃতি বাতিল করে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ায় মনোনিবেশ করেন। প্রতিক্রিয়াস্মরূপ মার্কিন কংগ্রেস সে সময় ‘তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্ট’ পাস করে। ওই আইন অনুসারে, তাইওয়ানকে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

তাইওয়ান রিলেশনস অ্যাক্টে আরও উল্লেখ করা হয়, তাইওয়ানে চীনের যে কোনো আক্রমণ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গভীর উদ্বেগের বিষয়। ১৯৯৬ সালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রভাবিত করতে উসকানিমূলক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় চীন। জবাবে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর এশিয়ায় মার্কিন সামরিক শক্তির সবচেয়ে বৃহৎ প্রদর্শনী করেন। তাইওয়ান উপত্যকায় যুদ্ধ জাহাজ পাঠিয়ে চীনের প্রতি পরিষ্কার বার্তা পাঠিয়ে দেন।

বিবিসি অবলম্বনে

সারাবাংলা/এটি

চীন তাইওয়ান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর