‘আওয়ামী লীগ একটি অনুভূতির নাম’
৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৮:৫১
।। নৃপেন রায়, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ২০১৬ সাল। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রীতি অনুযায়ী বক্তব্য রাখার কথা সাধারণ সম্পাদকের। সেই বক্তব্য রাখতে মঞ্চে উঠলেন সৈয়দ আশরাফ। হাতে লিখিত বক্তব্য থাকলেও পড়লেন না সেটি। সবাইকে অনুরোধ করলেন সেই বক্তব্য পড়ে নিতে। তবে থেমে থাকলেন না। মন থেকে বললেন কিছু কথা, সৈয়দ আশরাফের নাম শুনলেই যে কথাগুলো এখনও সেই সম্মেলনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের কানে বেজে ওঠে।
সৈয়দ আশরাফ বলেছিলেন, প্রিয় ভাই ও বোনেরা, ‘আওয়ামী লীগের আমি সন্তান, আওয়ামী লীগের ঘরেই আমার জন্ম। আওয়ামী লীগ যদি ব্যথা পায়, আমিও বুকে ব্যথা পাই। আওয়ামী লীগের কোনো কর্মী যদি ব্যথা পায়, আমারও অন্তরে ব্যথা লাগে। আওয়ামী লীগ তো আওয়ামী লীগই, এটা কোনো দল না, এটা আমার কাছে একটা অনুভূতির নাম।’
আরও পড়ুন- ‘আওয়ামী লীগের সন্তান আমি, এ ঘরেই আমার জন্ম’
বৃহস্পতিবার (৩ জানুয়ারি) রাত সাড়ে ৯টায় থাইল্যান্ডের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন সৈয়দ আশরাফ। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। অসুস্থ অবস্থাতে বিদেশে থেকেই অংশ নিয়েছিলেন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, বিজয়ীও হয়েছিলেন নির্বাচনের পুরোটা সময়ে একবারের জন্যও দেশে উপস্থিত না হয়ে— এমনই জনপ্রিয়তা ছিল তার।
এক বিপর্যস্ত সময়ে দায়িত্ব পেয়ে টানা দুই মেয়াদে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পর ২০১৬ সালের ওই সম্মেলনেই সাধারণ সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন সৈয়দ আশরাফ। তাকে নিয়ে নানা ধরনের গুঞ্জন যখন বাজারে চাউর, তখন ওই জাতীয় কাউন্সিলে তিনি নিজেই নতুন সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন ওবায়দুল কাদেরের নাম।
আরও পড়ুন- সৈয়দ আশরাফ আর নেই
ওই সম্মেলনে সৈয়দ আশরাফ বলেন, আমি দুই দুইবার দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। শেখ হাসিনার উপদেশে দলকে পরিচালনা করেছি। আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো ভাঙন ধরেনি, কোনো ইজমও তৈরি হয়নি। আমরা সবাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করেছি। আজ আমাদের দল যেকোনো সময়ের থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী।
যেকোনো পরিস্থিতিতে দলীয় নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকাকেই মূলমন্ত্র মনে করতেন সৈয়দ আশরাফ। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ শুধু একটা রাজনৈতিক দল নয়। হাজারও শহীদের রক্ত, জাতির পিতার রক্ত, জাতীয় চার নেতার রক্ত, হাজার হাজার নেতাকর্মীর আত্মত্যাগ— সব মিলিয়েই আওয়ামী লীগ। এই আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটা অনুভূতি। এই হাজারও বন্ধুর রক্ত, চার নেতার রক্ত, ভাষা আন্দোলনের রক্ত— সেই অনুভূতি। এই অনুভূতিতে সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগ।
আরও পড়ুন- সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো: রাষ্ট্রপতি
আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করার জন্য অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে উল্লেখ করে বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি বলেন, এরপরও কিন্তু আওয়ামী লীগকে নিঃশেষ করতে পারেনি এবং কোনোদিনই পারবে না, কোনোদিনই পারবে না। জননেত্রী যতদিন আছেন, তিনিই দলের নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু এই জননেত্রী শেখ হাসিনা যদি না থাকেন, আওয়ামী লীগ কিন্তু মরবে না। কারণ আওয়ামী লীগ অজেয় রাজনৈতিক সংগঠন। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে পৃথিবীর কোনো শক্তি নাই, এই আওয়ামী লীগকে স্তব্ধ করে দিতে পারে।
ওই সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যেও সৈয়দ আশরাফ দলকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একতাবদ্ধ রেখে এগিয়ে যাওয়ার ওপরই জোর দেন। জোর দেন ব্যক্তি স্বার্থের ওপরে দলের ও দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ার ওপর। দলে অশুভ শক্তির চর, সন্ত্রাসী, মাদকসেবী, অসৎ ও বিতর্কিত ব্যক্তির অনুপ্রবেশ যেন না ঘটে, সেদিকেও সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
আরও পড়ুন- সৈয়দ আশরাফের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক
আওয়ামী লীগের ভিত্তি জনসমর্থন এবং সেই জনসমর্থনের দিকেই সবাইকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সৈয়দ আশরাফ বলেন, কাউন্সিলে হাজার হাজার কাউন্সিলর ও ডেলিগেটদের অংশগ্রহণই প্রমাণ করে আওয়ামী লীগ জনগণের দল। আজ এমন একটি দিনে কাউন্সিল হচ্ছে, যখন দেশ নিয়ে আবার নতুন করে শুরু হয়েছে ষড়যন্ত্র। উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠীর মাধ্যমে জনমনে ভীতি সঞ্চার করে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে এই অশুভ শক্তি। চক্রান্ত চলছে একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার, গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার।
তিনি বলেন, আসুন আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি— এ দেশে গণতন্ত্র থাকবে নাকি অনির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে? এ দেশে কি আবার উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠীর বিচরণ ভূমি হবে নাকি উদার গণতান্ত্রিক দেশ হবে? এ দেশে কি আবার বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হবে নাকি আইনের শাসন চলবে? এ দেশ কি সিরিয়া-ইরাক-আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন যুদ্ধবিধস্ত দেশে পরিণত হবে নাকি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যাবে?
দলের প্রতিটি সদস্যকে সমান গুরুত্ব দিতেন সৈয়দ আশরাফ। সে কারণেই প্রতিটি কর্মীকেই দলের অর্জনকে সবার সামনে তুলে ধরার আহ্বান জানান তিনি। বলেন, মনে রাখতে হবে— প্রতিটি নেতাকর্মীই দলের একেকজন প্রচারক।
সারাবাংলা/এনআর/এমএমএইচ/টিআর