মন্ত্রিসভায় কমেছে দল কমিটির হিস্যা
৬ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:৪১
।। তরিকুর রহমান সজীব, জয়েন্ট নিউজ এডিটর ।।
ঢাকা: সব কৌতূহলের অবসান ঘটিয়ে বেশকিছু চমক নিয়ে এলো নতুন মন্ত্রিসভার ঘোষণা। প্রধানমন্ত্রীসহ ৪৭ সদস্যের এই মন্ত্রিসভায় ২৭ জনই একেবারে আনকোরা। অর্থাৎ তারা প্রথমবারের মতো নিতে যাচ্ছেন মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করে আসা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও উপদেষ্টা পরিষদের অনেক সদস্যেরই ঠাঁই মেলেনি এই মন্ত্রিসভায়। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির খুব অল্পসংখ্যক সদস্যই স্থান পেয়েছেন এতে। সে হিসাবে বলাই যায়, দলকে সরকার থেকে যতটা সম্ভব আলাদা করতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবনার প্রতিফলনই স্থান পেয়েছে এবারের মন্ত্রিসভার গঠনে।
আরও পড়ুন- ২৫ মন্ত্রী, ১৯ প্রতিমন্ত্রী, ৩ উপমন্ত্রীর মন্ত্রিসভা
রোববার (৬ জানুয়ারি) বিকেলে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রিসভার তালিকা ঘোষণা করেন। ঘোষিত মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রী ছাড়া পূর্ণ মন্ত্রী রয়েছেন ২৪ জন, প্রতিমন্ত্রী রয়েছেন ১৯ জন ও উপমন্ত্রী রয়েছেন তিন জন। তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের সর্বশেষ কাউন্সিলে গঠিত ১১৮ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির মাত্র ১৪ জন স্থান পেয়েছেন নতুন মন্ত্রিসভায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া এই তালিকায় রয়েছেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, অর্থ সম্পাদক টিপু মুন্সী, আইন বিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম, ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ।
আরও পড়ুন- পূর্ণ মন্ত্রী হলেন যারা
এছাড়া, আট সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল রয়েছেন মন্ত্রিসভায়। আর সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন নুরুল মজিদ হুমায়ুন ও মন্নুজান সুফিয়ান। তবে, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও উপদেষ্টা পরিষদের হেভিওয়েট বেশ কয়েকজন নেতার স্থান হয়নি এই মন্ত্রিসভায়। আওয়ামী লীগের একাধিক মেয়াদে মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করলেও প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ, লে. কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ ফারুক খান, অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর স্থান হয়নি নতুন মন্ত্রিসভায়।
আরও পড়ুন- মন্ত্রিসভা থেকে ‘হেভিওয়েট’সহ বাদ পড়লেন যারা
এদিকে, দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত, আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, এইচ টি ইমাম, ড. মশিউর রহমান, অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, মহীউদ্দীন খান আলমগীর, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের মতো প্রবীণ-অভিজ্ঞ নেতা ও সাবেক মন্ত্রীরাও আসনে পারেননি নতুন মন্ত্রিসভায়। এছাড়া দলের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে আব্দুস সোবাহান গোলাপ, অসীম কুমার উকিল, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাসিম, বি এম মোজাম্মেল হক, সহ-দফতর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, কার্যনির্বাহী সদস্য আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, সিমিন হোসেন রিমি, ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী, মির্জা আজমের মতো নেতাদের উপস্থিতিও নেই এই মন্ত্রিসভায়। এবারের মন্ত্রিসভার তালিকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ৪৭ জনের মধ্যে ২৭ জন একেবারেই নতুন, এর আগে কখনো কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামলানোর অভিজ্ঞতা নেই যাদের। এর বাইরে চার জন রয়েছেন, যারা নবম সংসদে মন্ত্রিত্বের স্বাদ পেলেও দশম সংসদে ছিলেন মন্ত্রিসভার বাইরে।
আরও পড়ুন- মন্ত্রিসভায় নেই আ.লীগের শরিকরা
অন্যদিকে, দশম সংসদে মন্ত্রিসভা গঠনের সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ১৫ জনের স্থান হয়েছিল। আওয়ামী লীগের ওই মেয়াদের কমিটিতে সদস্য ছিলেন মাত্র ৭১ জন। সেই হিসাবে দশম সংসদের মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের উপস্থিতি ছিল ২১ শতাংশেরও বেশি। আর একাদশ সংসদে এসে এই হার ১২ শতাংশেরও কম। কেবল শতাংশের হারেই নয়, আগের মন্ত্রিসভার তুলনায় হেভিওয়েট নেতাদের উপস্থিতিও নতুন মন্ত্রিসভায় কম। আগের মন্ত্রিসভায় যেখানে মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, তোফায়েল আহমেদ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, নুরুল ইসলাম নাহিদ ও আসাদুজ্জামান নূরের মতো শীর্ষ নেতারা স্থান পেলেও সে তুলনায় নতুন মন্ত্রিসভায় নবীনদেরই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন- অর্থমন্ত্রী: সিলেট যুগের অবসান
আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্রগুলো বলছে, টানা দুই মেয়াদে সরকারে থাকার ফলে এরই মধ্যে দল আর সরকারের মধ্যে বিভাজনের রেখাটা অনেকটাই অস্পষ্ট হয়ে গেছে। ফলে সরকার সামলাতে গিয়ে যখন দলের হেভিওয়েট নেতারা ব্যস্ত থেকেছেন, সেই ফাঁকে দলের মধ্যে অনেক ক্ষেত্রেই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অন্তর্কোন্দলেও জড়িয়ে পড়েছেন। যা শেষ পর্যন্ত দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সুনাম অনেকাংশে ক্ষুণ্ন করেছে। সে কারণেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই দলের বেশকিছু কেন্দ্রীয় নেতাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তাদের দায়িত্ব ছিল দলকে নির্বাচনের সময় সামলানো। আশঙ্কা ছিল, টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকার পরিচালনা করতে গিয়ে দল আর সরকারের মধ্যেকার সেই বিভেদ রেখা আরও অস্পষ্ট হয়ে যেতে পারে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর দলীয় নেতাদের কেউ কেউ তাই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, দলের হেভিওয়েট নেতাদের দল গুছিয়ে রাখার দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভাকে আলাদা করে ফেলতে পারেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোববার ঘোষিত মন্ত্রিসভায় মূলত সেই চিন্তারই প্রতিফলন দেখা গেলো।
সারাবাংলা/টিআর/এমএনএইচ